বিদিশার সাথে প্রথম পরিচয় ক্যান্টিনে। সেই শুরু, তারপর অজস্র দিন একসাথে আড্ডা সিনেমা খাওয়া দাওয়া হতেই থাকতো। লম্বা চুলের গোছা মেয়েটি কে প্রায় বলতাম -"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার পান্ডুর শ্রাবস্তীর কারুকার্য্য ----"
শুনেই হো হো হেসে উঠতো। প্রায় দেখতাম লম্বাটে টাইপের একটা ছেলে বাইকে করে কলেজে ছেড়ে দিয়ে যেত। কোনদিন আর সেভাবে ফুরসত হয়নি ছেলেটির পরিচয় জিজ্ঞেস করার। মুর্শিদাবাদের মেয়ে এখানে তার পিসির বাড়ি তে থেকে পড়াশোনা করে-সম্ভবত ছেলেটি তার বয়ফেন্ড কাম লোকাল গার্ডিয়ান হবে। আমাদের চার জনের মধ্যে অরূপ আর প্রিয়াংকা অলরেডি এনগেজড ছিল। আমারও যে বিদিশা কে ভাললাগতো না তা কিন্তু নয়, কিন্তু চিরকাল মুখচোরা ছিলাম তাই আর মুখ ফুটে বলা হয়নি। অবশ্য বিদিশা ও কোনদিন বলেনি। জাস্ট একবার প্রিয়াংকা বলেছিল আমি যখন কথা বলতাম বিদিশা আমাকে অপলক ভাবে তাকিয়ে দেখতো।
* * * * *
মা রোজই বলে আমাকে বিয়ে করতে। বয়স বেড়েই চলেছে, আমি কিন্তু কাজের মধ্যে ডুবেই থাকি। কলেজ ছাড়ার পর মাস্টার্স করলাম। তারপর একদিন প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়ে বসে পড়লাম আই .পি .এস পরীক্ষায়। হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং শেষে প্রথম পোস্টিং উত্তর বঙ্গে। বিদিশার সাথে কলেজ ছাড়ার পর আর দেখা হয়নি, হয়তো তার গ্রামের বাড়ি মুর্শিদাবাদ চলে গেছিল। সবার কন্টাক্ট নম্বর থাকলেও আশ্চর্য্যজনক ভাবে বিদিশার নম্বর ছিলনা। প্রথম টা নিজের উপর খুব রাগ হতো কেন বিদিশার নম্বর কাছে রাখিনি, আসলে প্রতিদিন কলেজে দেখা হতো তাই আমিও অনেকটা জোর করে চাইনি আর সেও দেয়নি নিজে থেকে। ইতিমধ্যে অরূপ আর প্রিয়াংকার বিয়ে হয়ে ওরা দিল্লি চলে গেছিল, অরূপ ওখানেই একটা কলেজে পড়াতো। কিন্তু শেষের দিকে অনেক বার মনে পড়তো কিন্তু কিছু করার নেই হয়তো এতদিনে বিয়ে হয়ে ছেলে মেয়ের মা হয়ে গেছে। উত্তর বঙ্গে প্রায় দু বছর সার্ভিস করার পর অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে এলাম। বাবা সেই ছোট থেকে নেই -মা আমি আর একজন কাজের মাসি আর দীর্ঘদিনের বাড়ির একমাত্র কেয়ার টেকার কার্তিক কাকা নিয়ে সংসার আমাদের। অবশ্য আমার সর্বক্ষনের সঙ্গী মহাবীর-আমার ড্রাইভার। সোনার পুরের পৈতৃক বাড়ি তে বলতে গেলে প্রায় সারাটা দিন মায়ের একাই কাটে। আমি কলকাতা নর্থ এর ডিসি ডিডি ক্রাইম ব্রাঞ্চ। দিন গুলো এভাবেই কেটে যায়, প্রতিদিন ডিউটি শেষ করে বাড়ি ফিরে ঘন্টা খানেক টিভি দেখা, তারপর ডিনার শেষে প্রতিদিনের জরুরি কিছু ফাইল দেখে রাতে ঘুমাই। মাঝে মধ্যে পার্টি বা কোন ইনভাইটেশন থাকলে সেটা আলাদা কথা।
সেদিন ছিল কমিশনার সাহেবের বিবাহ বার্ষিকী পার্টি, কমিশনার সাহেবের পার্টি বলে কথা-উপস্থিত তো হতেই হবে। স্যারের বাড়ি দমদমে, ড্রাইভার মহাবীর ছুটি নিয়ে দুদিনের জন্য তার দেশের বাড়ি গেছে। তাই গাড়ি আপাতত গ্যারেজে-কারন মা পইপই করে বারন করেছে গাড়ি ড্রাইভ না করতে। এর আগে একবার নিজে ড্রাইভ করে ইলেকট্রিক খুঁটি তে ধাক্কা মেরে শয্যাশায়ী হয়েছিলাম। যাইহোক জয়েন্ট কমিশনারের গাড়ি তে করে কমিশনার সাহেবের বাড়ি পৌঁছলাম সন্ধ্যেবেলা। বাড়ি ফেরার সময় একটা ক্যাব ধরে নিলেই হবে , কিন্তু পার্টিতে আড্ডা দিতে দিতে ভুলেই গেছি ক্যাবের কথা। রাত দশ টার দিকে বেরিয়ে আসতে ক্যাবের কথা মনে পড়লো। ভাবছি একটা ট্যাক্সি ধরবো, হঠাৎ ভূত চাপলো নরমাল পোশাকে বাসে করে বাড়ি ফিরি, চাকরি পাওয়ার পর বহুদিন বাসে উঠিনি, এইসব ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম একটা অটো ধরে শ্যামবাজার পৌঁছে ওখান থেকে বাসে করে দক্ষিন কলকাতা যাবো ।
ঠিক সে সময় একটা অটো আসতেই হাত দেখিয়ে উঠে পড়লাম। অটো থেকে নেমে হেঁটে চলছি বাস স্ট্যান্ডের দিকে, বেশ আলো আঁধারি -হঠাৎ কানে আসলো,"বাবু মাত্র তিনশ টাকা একটা শট"
ঘেন্নায় গা রিরি করে উঠলো, কোন রকমে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললাম, মনে পড়লো ক্রাইম ব্রাঞ্চের মুখার্জী সেদিন বলছিল বেশ কিছু বাংলাদেশী মেয়ে সীমান্ত পাচার হয়ে কলকাতা পৌঁছেছে এই বড়দিন-ক্রিসমাস উপলক্ষে-জাস্ট উপর তলা থেকে অর্ডার পাওয়া যাচ্ছেনা তাই রেইড করা যাচ্ছে না ।
হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম -আশ্চর্য! গলা খুব চেনা মনে হলো মেয়েটার। কি মনে হলো পিছু ফিরে দাঁড়াতেই দেখি আলো আঁধারি তে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে-মুখ টা চেনা যাচ্ছেনা বেশ আবছা লাগছে-দূর থেকে একটা সরু তির্যক আলো এসে পড়ছে। আমি এগিয়ে গেলাম মেয়েটার দিকে। দূর থেকে আসা আলোর আভায় এতদিন পরেও স্পষ্ট চিনতে পারলাম -বিদিশা! সেই লম্বা টাইপের মুখ কোঁকড়ানো চুল-অনেক চেষ্টা করেও মুখ থেকে আওয়াজ বেরোল না-তারপর নিজের সমস্ত শক্তি জড়ো করে বললাম,"বিদিশা, তুমি!"
কয়েক সেকেন্ডের বিরতি-ঘটনা পরম্পরায় প্রথম টা বিদিশা হতচকিত হয়ে গেছিল কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে মুখ ফিরিয়ে সে হাঁটতে শুরু করলো, আমি চিৎকার করলাম, বিদিশা দাঁড়াও।
কিন্তু কোন কথা না শুনে প্রচন্ড গতিতে হাঁটতে লাগলো, উপায়ন্তর না পেয়ে আমি ও অন্ধের মতো পিছু নিলাম ।নিষিদ্ধ পল্লীতে আসতে থাকা অজস্র মানুষ কে পাশ কাটিয়ে সে চলতে লাগলো জোরে, আমি ও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম ডাকার, কিন্তু সে থামলো না। শেষ পর্যন্ত আমরা একটা গলির মধ্যে এসে ঢুকলাম, বেশ নির্জন গলি, বিদিশা প্রচন্ড জোরে পা ফেলছে, আমি কোন উপায় না দেখে দৌড় দিয়ে তার কাছে এসে পৌঁছলাম , হাত ধরে প্রবল ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড় করাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, কোন কথা নেই। আমি তখন নিজেই ঠিক করে উঠতে পারিনি কি জিজ্ঞেস করবো, হালকা আলোয় বুঝতে পারলাম বিদিশা ফুঁপিয়ে উঠলো। পকেট থেকে রুমাল বার করে এগিয়ে দিতে গিয়ে অনুভব করলাম কয়েকফোঁটা অশ্রু রাশি আমার হাতের উপর পড়লো।
* * * * * *
বিদিশার বাবা একজন ব্রাহ্মন পুরোহিত, জমি জায়গা নেই-পুরুত গিরি করেই সংসার চলতো, মা অল্প বয়সে মারা যাওয়ার পর বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন, কিন্তু কোনদিন ও দুচোখে দেখতে পারতেন না বিদিশা কে। শেষমেষ বৃদ্ধ ব্রাহ্মন বিদিশা কে কলকাতায় পিসির বাড়ি তে পাঠিয়ে দেন, পিসেমশাই এবং পিসিমা দুজনেই খুব ভালোবাসতেন বিদিশা কে নিজের মেয়ের মতোই, যে ছেলে টা কে আমি দেখতাম বিদিশা কে বাইকে করে কলেজে ছেড়ে দিয়ে যেত আর ভাবতাম বিদিশার বয়ফ্রেন্ড, আদতে সে ছিল তার পিসতুতো দাদা। কলেজ ছাড়ার পর যখনই বিদিশা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এম এ তে ভর্তি হবে ঠিক তখনই পিসতুতো দাদার একটা কিডনি নষ্ট হয়ে যায়, এদিকে এমনই দুর্ভাগ্য যে যে কারখানায় পিসে মশাই লেবার হিসেবে কাজ করতেন সেই কারখানার গেটে ও তালা পড়ে শ্রমিক -মালিক বিবাদে। নিত্য দিনের ডায়ালাইসিস আর চিকিৎসা করিয়েও শেষ পর্যন্ত পিসতুতো দাদা মারা গেল, কিন্তু এদিকে যা হওয়ার হয়ে গেছে, বাড়ি গাড়ি গয়না সব বিক্রি করে পিসে মশাই পথের ভিখারী, থাকার মধ্যে কয়েকটা বাসন কোসন আর জামা কাপড়। সদ্য পুত্রহারা মা মানসিক ভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে গিয়ে একরকম প্যারালাইজ হয়ে গেলেন। মাসে অনেক টাকা খরচ চিকিৎসা করাতে, বিদিশা অনেক চেষ্টা করেছিল লোকাল পার্টির দাদা দের কাছে যদি কিছু সাহায্য পাওয়া যায়। সাহায্য তো পায়নি উপরন্তু অসহায়তার সুযোগ অনেকেই নেওয়ার চেষ্টা করেছে। বাড়ি ঘর সব হারিয়ে অনেক জায়গা ঘুরে শেষমেষ বুড়োবুড়ি কে নিয়ে খান্নার কাছে একটা ফ্লাইওভারের নিচে আশ্রয় নেয়, দিনের বেলা একটা সাবান কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে দোকান দোকান ঘুরে হাজার তিনেক টাকা আয় করতো কিন্তু তাতে করে দুটো অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চিকিৎসা করা অসম্ভব বুঝতে পেরে রাতের বেলা তার এই অভিযোজন।
ঘুম আসছিল না। চুপচাপ শুয়ে আছি, রাত প্রায় একটা বাজে। গলির ভিতর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিদিশার কাহিনী শুনতে শুনতে যেন হারিয়ে গেছিলাম, তারপর বিদিশার সাথে হেঁটেই গেলাম ফ্লাইওভারের নিচে, দুদিকে কাপড় দিয়ে ঘেরা-উপরে ফ্লাইওভার -এটাই বিদিশার প্রাসাদ। ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতে সারা কলকাতা কাঁপছে সেখানে ওরা তিনজন এভাবেই লড়াই করছে শীতের বিরুদ্ধে। কাছে বেশি টাকা ছিলনা, পার্স বার করে একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে বিদিশার হাতে চলে এসেছি। একটা তীব্র যন্ত্রনা নিজের মধ্যে কুরে কুরে খাচ্ছিল, উঠে গ্লাসে থাকা জল ঢকঢক করে খেলাম। সোজা রুম থেকে মায়ের ঘরে এলাম, মা ঘুমিয়ে আছে, একমুহূর্ত চিন্তা করলাম, এক্ষুনি কি মা কে ডাকবো না কাল সকালে বলবো-এইসব ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে আসছিলাম, মা ডাকলো, আমি ঘুমাইনি জেগে আছি, কিছু বলবি ?
খানিকটা ইতস্ততঃ করে সমস্ত কিছু খুলে বললাম।
মা জিজ্ঞেস করলো, তুই কি চাস?
আমি বললাম, বিদিশা কে তোমার বৌমা হিসেবে এই বাড়ি তে আনতে চাই।
মা কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললো, ওর পিসেমশাই আর পিসিমা উনাদের কি হবে?
দেখলাম মা আমার দিকে তির্যক ভাবে তাকিয়ে আছে, একটু সময় নিয়ে বললাম, এই এতবড় বাড়ি তে তিনজন মানুষ যদি থাকতে পারে তাহলে আরো দুজনের ও জায়গা হয়ে যাবে।
মা একটু চুপ থেকে বললো তোর বাবা নেই, তোকে শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে উপযুক্ত করেছি, যেটা ভালো বুঝিস সেটাই কর।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসলাম।
* * * * * *
পরের দিন মহাবীর ফিরে আসতে অফিস থেকে বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়লাম, গাড়িটা একটু দূরে পার্ক করে একাই হেঁটে চলে গেলাম, বিদিশা বসে বসে একটা কাঁথা সেলাই করছে পুরোনো কাপড় চোপড় দিয়ে, একটু দূরে পিসিমা ঘুমাচ্ছেন আর পিসেমশাই কে দেখতে পেলাম না হয়তো কাছাকাছি কোথাও আছেন। আমাকে দেখে বিদিশা মলিন হাসি হাসলো, বসতে দেওয়ার জায়গা নেই, সে শসব্যস্ত হয়ে কাঠের চৌকি দিল বসতে, আমি বসলাম না দাঁড়িয়েই থাকলাম।
মনের কোনে ভেসে উঠছিল কলেজ জীবনের কত অজস্র ঘটনা, ক্যান্টিনে বসে সারা দুপুর জুড়ে আড্ডা, হঠাৎ বিদিশা বললো, জীবনে অনেক কিছুই অপূর্ন থেকে গেল, ইচ্ছে গুলো পুরন হলোনা।
আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বললাম, আমারও অনেক কিছু অপূর্ন থেকে গেছে।
l
বিদিশা বললো,"বেশ তো সুখী মানুষ তুমি, তোমার আবার কি আশা থেকে গেল ?"
অস্তরাগ সূর্য্যের হালকা আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, আমি বললাম সে তুমি ঠিকই বলেছ, টাকা-সন্মান সে সবের অভাব নেই, তবুও অনেক কিছু বাকি থেকে গেছে।
বিদিশা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি বাকি থেকে গেছে?
আমি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম বিদিশার দিকে তারপর ধীরে ধীরে বললাম,"তোমাকে ভালবাসতাম। মুখচোরা ছিলাম তাই আর মুখফুটে বলতে পারিনি।"
গোধূলির লাল আলোর আভায় লক্ষ করলাম বিদিশার মুখটা রক্তাভ হয়েগেছে লজ্জায় । সেটা লক্ষ করেই বললাম,"কিন্তু সেদিনের সেই লজ্জা আজ আর নেই তাই এখন সামনা সামনি বলতে পারি -ভালোবাসি।"
সমাপ্ত
© FB.com/shyamal.majumder.39501