শ্রেয়া বললো, "আমি চেন্নাই চলে যাচ্ছি। বছর খানেকের জন্য ওখানে বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের একটা কোর্স করবো।"
সন্দীপ দাঁড়িয়ে দেখছিল স্টিমার গুলো কিভাবে গঙ্গার বুক চিরে সন্ধ্যেবেলা যাত্রী নিয়ে হাওড়ার দিকে এগিয়ে চলেছে। এতদিনের সম্পর্ক টা হঠাৎ করেই যেন শেষের পথে। তিলতিল করে গড়ে ওঠা একটা প্রাসাদ হঠাৎ করেই যেন আকস্মিক ঝড়ে ভূপতিত। গত কয়েক মাস ধরেই সমস্যা পিছু ছাড়ছে না। হঠাৎ করেই শ্রেয়ার জীবনে হাজির হয়েছিল অভিষেক। সেন অ্যান্ড পন্ডিত গ্রুপের চেয়ারম্যান চন্দন সেনের ছেলে। প্রায় এনগেজমেন্ট হতেই যাচ্ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে শ্রেয়া বেঁকে বসায় বাতিল হয়ে যায় এনগেজমেন্ট। আসলে শ্রেয়া তার জীবনে একটা রূপকথার রাজকন্যার মতো। স্ট্যাটকন গ্রুপের পূর্বাঞ্চলীয় রিজিওনাল প্রধান সঞ্জয় রায়ের একমাত্র মেয়ে শ্রেয়া। কৈখালী তে বিশাল বাড়ি, ছোটবেলা থেকে মা নেই। যখন ক্লাস সেভেনে পড়ে সেসময় গলার ক্যান্সারে মারা যান।
-"তুমি কি ভাবছো?"
শ্রেয়ার প্রশ্নে হুঁশ ফিরলো সন্দীপের।
সন্দীপ ম্লান হাসি হেসে বললো, "নাহ, কিছুই ভাবার মতো নেই। সব কিছুই তো তুমি ডিশিসন নিয়েই রেখেছো। এখানে আমি বাধা দিলেও তো তুমি থামবে না। সেই যাবে চেন্নাই। মাঝখানে তর্কবিতর্কে সম্পর্ক টা অনেক খারাপ হবে।"
তারপর একটু থেমে বললো ,"যাও। আমি আর বাধা দিলাম না।"
শ্রেয়া খানিকক্ষন চুপ থেকে বললো, "তুমি কি চলে যাবে বাড়ি এখন?"
সন্দীপ বললো, "হ্যাঁ আজ রাতের ট্রেনেই। যেভাবে প্রতিবারে কলকাতা থেকে ফিরি।"
শ্রেয়া একটু ভাবলো, "তারপর বললো চলো তোমাকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিচ্ছি।"
সন্দীপ কোন প্রতিবাদ করলো না, তারা দুজনে বেরিয়ে এলো পার্ক থেকে। বাইরে রাস্তার উল্টোদিকে শ্রেয়ার ফেরারী টা পার্ক করা ছিল। দরজা খুলে দুজনে বসতে গাড়ি টা ঝড়ের গতিতে হাওড়া স্টেশনের দিকে চলে গেল।
* * * * * *
নীলিমা জিজ্ঞেস করলো, "তুই এই মিথ্যে টা বলতে পারলি?"
শ্রেয়া রেগে মেগে বলে উঠলো, "কিসের মিথ্যে? যা করেছি ঠিক করেছি।"
নীলিমা অবাক হয়ে বললো, "ঠিক করেছিস? কি করে এটা তুই বলতে পারছিস?"
শ্রেয়া মুখটা অন্যদিকে করে বললো,"বলে দেওয়া সহজ, কখনো আমার জুতোয় পা ঢুকিয়ে হেঁটে দেখিস চলার পথ কতটা কঠিন, তাহলে বুঝতে পারতিস কতটা কঠিন হয়ে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।"
নীলিমা সবই জানে, কিকরে সন্দীপের সাথে শ্রেয়ার পরিচয় প্রেম, তারপর কি করে অভিষেক এসেগেছে শ্রেয়ার জীবনে। শ্রেয়াই সন্দীপের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নীলিমার। হোক না গ্রামের ছেলে কিন্তু নিঃসন্দেহে খুব ভালো ছেলে। শহুরে ছেলে গুলোর মতো মোটেও হামবড়া ভাব নেই । সহজ সরল এবং একটু লাজুক টাইপের। যেদিন পরিচয় হয়েছিল সেদিন নিজে থেকেই বলেছিল যে খুব সামান্য টাকা আয় করে সংসার চালায় সে, তার এই সহজ সরল স্বীকারোক্তিই নীলিমার মন ছুঁয়ে গেছিল, যদিও গোড়া থেকে নীলিমার সন্দেহ ছিল এই সম্পর্ক নিয়ে কারন নীলিমার বাবা সঞ্জয় আংকল কোন ভাবেই এইসব ফিল্মি প্রেম ভালোবাসা মেনে নেবেন না। তবুও কোথাও যেন একটা আলাদা ভরসা ছিল কারন তার প্রিয় বান্ধবী পোয়েম ওরফে শ্রেয়া চিরদিনই একটু আলাদা টাইপের মেয়ে বলেই। তবুও শেষ মুহূর্তে শ্রেয়ার এই মিথ্যাচার টা তার মন মেনে নেয়নি।
* * * * * *
সন্দীপ বুকের বামদিকে হাত দিয়ে দেখলো, এখনো জায়গা টা ঠিক মতো মসৃন হয়নি, উঁচুনিচু মাংসের ডেলা। একটা টিউমার হয়েছিল বুকের বাম পাশে, লোকাল ডাক্তার দেখে বলেছিলেন নরমাল ব্যাপার এগুলো। কিন্তু পরে অনেক টেস্ট করার পর ধরা পড়েছিল যে আদতে লাইপোমা হলেও ওটা ভিতরে ভিতরে অনেকটা বেড়ে গেছে। অনেক টাকার প্রয়োজন হয়েছিল-প্রায় ত্রিশ পয়ঁত্রিশ হাজার টাকা, কিন্তু শ্রেয়া জোর করে একরকম অপারেশন টা করিয়েছিল নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ।
শ্রেয়ার কথা মনে পড়তেই বুক টা চিনচিন করে উঠলো। আসলে স্বপ্ন গুলো এমনই হয়। সুন্দর একটা ডিপি দেখে হঠাৎ এক গ্রীষ্মের দুপুরে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট করেছিল, ওদিক থেকে অ্যাকসেপ্ট করতেই জাস্ট ফ্লার্ট করার জন্যই একটা বাজে ছবি ইনবক্সে পাঠিয়ে দিয়েছিল। হয়তো অন্য মেয়ে হলে ব্লক করে দিতো, কিন্তু ওপাশ থেকে মেয়েটা জাস্ট প্রশ্ন করেছিল,"আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি তাহলে কেন একটা ছবি তুমি আমাকে পাঠালে?"
স্থির শীতল একটা প্রশ্নে হতচকিত সন্দীপ বুঝতে পেরেছিল নিজের ভুল এবং সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চাওয়াতে ব্যাপারটা মিটে গেছিল। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য কারনে মেয়েটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বারবার মেসেজ করতেই থাকে। হয়তো প্রজাপতির ইচ্ছে ছিল তাই কয়েক দিনের মধ্যেই দুজনের সম্পর্ক টা ভার্চুয়াল জগতের কল্পনা থেকে বেরিয়ে বাস্তব জগতে বেরিয়ে এসেছিল। মেয়েটির নাম শ্রেয়া আর ডাক নাম পোয়েম। অদ্ভুত লেগেছিল পোয়েম নাম টা শুনে কারন বাংঙালি দের মধ্যে কারোর নাম পোয়েম হতে পারে সেটা কখনও কল্পনা ও করেনি সন্দীপ। তারপর গঙ্গা ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে, আর এদিকে দুজনের সম্পর্ক টা ফেসবুকের গন্ডী ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে। ছুটির দিন গুলো তে সন্দীপ কলকাতা চলে যেতো, তারপর সারাটা দিন শ্রেয়ার ফেরারী তে সওয়ারী হয়ে ইকো পার্ক থেকে ব্যারাক পুরের দাদা বৌদির বিরিয়ানি, ভিক্টোরিয়া হয়ে মিলেনিয়াম পার্ক ঘোরাঘুরি করে রাতের পুরী প্যাসেঞ্জারে ফিরে এসেছে। কিন্তু এতো সুখ হয়তো সহ্য হওয়ার নয় তাই ঝড়ের মতোই হঠাৎ একদিন শ্রেয়া বললো তার বাবার বন্ধু চন্দন কাকুর ছেলে অভিষেকের সাথে শ্রেয়ার বিয়ে হতে পারে। খবর টা শুনে প্রাথমিক ভাবে বিহ্বল হয়ে গেলেও কিছু করার ছিলনা, কারন কোথায় সিঙ্গাপুর থেকে বিজনেস ম্যানেজম্যান্টে স্নাতক করা, স্মার্ট, শিল্পপতির একমাত্র ছেলে অভিষেক আর কোথায় পশ্চিম মেদিনী পুরের উড়িষ্যা বর্ডার লাগোয়া এক অজ পাড়া গাঁয়ের টিউশানি করে দিন গুজরান করা ছেলে সে।
মানসিক ভাবে ভেঙ্গেই পড়েছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন শ্রেয়া বললো যে এনগেজমেন্ট বাতিল হয়ে গেছে কারন এই মুহূর্তে শ্রেয়ার কোন ইচ্ছে নেই বিয়ে নিয়ে, সে আরো স্টাডি করতে চায়। খবর টা শুনে খুব আনন্দ হয়েছিল মনের মধ্যে, যদিও স্বার্থপরতার হাসি বা আনন্দ, তবুও খুব আনন্দ হয়েছিল অন্তত এটা ভেবে যে হয়তো শ্রেয়া শুধু তারই তাই ঈশ্বরই ভেঙ্গে দিয়েছেন। বড়জোর মাস দেড়েকের ফারাক তারপরই একদিন শ্রেয়া বললো সে কলকাতা থেকে চেন্নাই চলে যাবে, এস .আর .এম ইউনিভার্সিটি তে অ্যাডমিট নিয়েছে তাই এখন কিছুদিন যোগাযোগ রাখতে চায়না।
কিন্তু চেন্নাই তে পড়াশোনা করতে গেলে যোগাযোগ রাখা যাবেনা? এটা কেমন যুক্তি! এখন কার এই সোশাল মিডিয়ার যুগে যোগাযোগ রাখা যাবেনা এটা অনেকটা হাস্যকর! কেন জানিনা শ্রেয়ার কাছে থেকে খবরটা শোনার পর মনে কেমন একটা সন্দেহের বাতাবরণ বইছে! এই সব ভাবতে ভাবতেই নীলিমার কথা মনে পড়লো। নীলিমা শ্রেয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড। একমাত্র নীলিমার সাথেই একদিন রাজারহাট সিটি সেন্টারে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল শ্রেয়া। খুব ভালো মেয়ে নীলিমা-প্রচুর হাসিখুশি আর খিস্তি দিতে ওস্তাদ । নীলিমার সাথে মাঝে মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ ফোনে কথা হয়। নিশ্চয় নীলিমা জানে সবকিছু যদি শ্রেয়া কিছু লুকিয়ে থাকে ।কিন্তু নীলিমা কি স্বীকার করবে? শ্রেয়া গত দশ তারিখে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভেটেড করেছে। শুধু বলেছিল অনেকে উল্টাপাল্টা ট্যাগ করবে তাই অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাকটিভ থাকা ভালো। ফোন নং টা যদিও চালু আছে অনেকটা অভিমানে সন্দীপ ফোন করেনি, হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে তেমন সবুজ চিহ্ন টা দেখা যায়নি দু তিন হলো। যদিও অনেকবার অনলাইন হয়ে হোয়াটসঅ্যাপ টা চেক করেছে কিন্তু কোন হদিশ পায়নি। যতই পড়ার চাপ থাকুক তবুও কি সপ্তাহে একবার ফোনে কথা বলা যায়না?
ফোন টা নিয়ে সন্দীপ নীলিমা কে কল করতেই কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর নীলিমা রিসিভ করলো।
নীলিমা প্রথমেই বললো,"হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে।"
সন্দীপ হেসে বললো, "তোমাকেও।"
নীলিমার বয় ফ্রেন্ড একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ।
তারপর একটু থেমে বললো, "একটা কথা জিজ্ঞেস করতে তোমাকে ফোন করা।"
নীলিমা হেসে বললো, "কিসের এত দরকার যে এতদিন পর আমাকে মনে পড়ল?"
সন্দীপ হেসে বললো, "আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম তাই সেভাবে খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি। "
নীলিমা হেসে বললো,"ওকে ওকে ঠিক আছে। কি দরকার একটা বলছিলে সেটা আগে শুনি।"
সন্দীপ কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলো, কিভাবে শুরু করবে ঠিক করতে পারছিল না, তারপর বললো,"সত্যি করে বলবে প্লিজ, শ্রেয়ার খবর কি? সে কি সত্যি চেন্নাই যাচ্ছে? "
নীলিমা ভাবলো তারপর বললো, "কিন্তু তোমাকে কি বলেছে?"
সন্দীপ বললো,"আমাকে বললো চেন্নাই চলে যাচ্ছে তাই পড়াশোনার যাতে কোন অসুবিধা না হয় যোগাযোগ এই মুহূর্তে রাখবে না।"
সন্দীপ ইচ্ছে করেই কয়েকদিন আগে শ্রেয়ার দেখা হওয়ার প্রসংগ টা তুললো না। তারপর বললো,"আমার কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে, এখন কার দিনে কেউ জাস্ট পড়াশোনার জন্য যোগাযোগ রাখেনা? এত ব্যস্ততা?"
নীলিমা চুপ ছিল , তার কিছু বলার ছিলনা।
সন্দীপ বললো,"প্লিজ চুপ করে থেকো না, প্লিজ বলো, আমি শুধু সত্যিটা জানতে চাই। তার কাছে আমার কোন রাগ অভিমান নেই বা কোন দাবি ও নেই।"
নীলিমার ও খারাপ লাগছিল এইভাবে একটা মিথ্যের প্রশ্রয় নিতে কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকে তার প্রিয় বান্ধবী পোয়েম।
কিন্তু সত্যি কে চেপে রাখা খুব অস্বস্তিকর, কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে নীলিমা বললো, "আজ সন্ধ্যের দিকে তুমি সায়েন্স সিটিতে স্প্রিং ক্লাবে আসতে পারবে?"
সন্দীপ হিসেব কষে দেখলো এখন দুপুর প্রায় বারোটা, বেরিয়ে খড়গ পুর স্টেশন যেতে ঘন্টা দুই, সেখান থেকে এক্সপ্রেস ধরলে মোটামুটি এক ঘন্টা কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে হাওড়া পৌঁছানো যাবে। সন্দীপ বললো,"আমি যাচ্ছি।"
নীলিমা বললো,"আমি সন্ধ্যে সাড়ে সাত টার দিকে আমিও যাবো। তুমি পৌঁছে আমাকে কল করো।"
* * * * *
সন্দীপ বাসের সিটে বসে বাইরে তাকালো, হালকা শীতের রেশ। ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে রুবির মোড়ে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে সারা শহর সেজে উঠেছে। হঠাৎ চোখে পড়লো একটু দূরে একটা গাছের দুই কলেজ পড়ুয়া সামনা সামনি দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে বেশ চুটিয়ে। মনে মনে হেসে উঠলো সন্দীপ, মেয়েটার কথা বলার হাত নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করার কায়দা অবিকল পোয়েমের মতো। পোয়েম ও কতদিন ঝগড়া করেছে। একবার তো সন্দীপের ট্রেন সাঁতরাগাছির কাছে এসে গ্যালোপিং হয়ে গেল টানা এক ঘন্টা লেট আর ওদিকে পোয়েম দাঁড়িয়ে আছে ফেরারী নিয়ে হাওড়া স্টেশনে, সেদিন ও ঠিক যেন এমনই ঝগড়া করেছিল শ্রেয়া। ফোন টা বিপবিপ করতে দেখলো নীলিমার মেসেজ। অনেক দেরি হয়ে গেছে ট্রাফিকে পড়ে। সে তাড়াতাড়ি মেসেজ করলো,"আমি রুবি তে আছি, খুব জ্যাম।"
নীলিমা কিছু বললো না কেন? সরাসরি স্প্রিং ক্লাবে ডাকার অর্থ কি? এইসব ভাবতে ভাবতেই বাস আবার চলতে শুরু করছে! সন্দীপের মনে প্রশ্নগুলো বারবার ঢেউ খেলতেই থাকে।
বাস থেকে নেমেই সন্দীপ এগিয়ে গেল, নীলিমা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল, সন্দীপ কে দেখে মুচকি হাসলো। এদিকটা কোনদিনও আসেনি সন্দীপ, বেশ অচেনা লাগছে পথ ঘাট। সে কোন কথা না বলে নীলিমা কে অনুসরন করতে লাগলো।
অনেকটা স্বপ্নাবিষ্টের ন্যায় কিছুটা চলার পর হঠাৎ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল নীলিমা, পিছন ফিরে বললো,"আমি চাইলে ব্যাপারটা চেপে যেতে পারতাম কারন তোমার চেয়েও আমার কাছে শ্রেয়ার ভ্যালু অনেক বেশি। তবুও আমার মনে হলো সত্যিটা জানিয়ে দেওয়া উচিৎ।"
সন্দীপ হাঁ করে তাকিয়ে রইল কিছু বুঝতে না পেরে ,
নীলিমা বললো,"এনগেজমেন্টের দেড় মাস পর আজকে একটা অফিসিয়াল পার্টি দিয়েছেন সঞ্জয় আংকল।অভিষেকের সব বন্ধু বান্ধবী দের সাথে আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে তে পরিচয় হয়ে যাক বিয়ের আগে।"
সন্দীপ কিছুটা বিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করলো,"কার এনগেজমেন্ট?"
নীলিমা বললো,"শ্রেয়া ও অভিষেকের।"
সন্দীপ উন্মাদের মতো বলে উঠলো,"এনগেজমেন্ট তো ভেঙ্গে গেছিল!"
নীলিমা মাথা নিচু করে বললো,"না ভাঙ্গেনি। পোয়েম তোমাকে মিথ্যে বলেছিল। কারন সে জানতো এতবড় আঘাত তুমি সহ্য করতে পারবে না। তাই তোমার মন রাখতে বলেছিল এনগেজমেন্ট হয়নি। কিন্তু এদিকে বিয়ের দিনও প্রায় ফিক্সড, তাই বাধ্য হয়ে তোমাকে মিথ্যে বলেছে চেন্নাই চলে যাচ্ছে।"
সন্দীপের চোখে অন্ধকার লাগলো, নিজেকে কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছেনা, একটা মৃদু যন্ত্রনা মাথার মধ্যেই হয়েই চলেছে তবুও মৃদু ভাবে বললো,"চেন্নাই যাচ্ছে মিথ্যে বললো কেন?"
নীলিমা বললো, "আসলে সে ভেবেছে, অনেকটা দিন যোগাযোগ না থাকলে হয়তো তুমি নিজেকে সামলে নিতে পারবে।"
ওরা একটু বাইরে দাঁড়িয়েছিল। গেট দিয়ে অজস্র মানুষ ঢুকছে বেরোচ্ছে।
নীলিমা বললো, "আমাকে ফোন করেছিল ওরা আসছে। কিন্তু আমাকে কথা দাও তুমি ওকে বলবে না আমি যে বললাম তোমাকে।"
সন্দীপের মাথা বনবন করে ঘুরছিল, কিছু বলার মতো অবস্থা ছিলনা। মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল গত দেড় বছরের অজস্র স্মৃতি। হঠাৎ গাড়ির আওয়াজে নীলিমা বললো,"ওই ওরা এসে গেছে।"
সন্দীপ মুখ তুলে দেখলো, দামী একটা বিদেশী গাড়ি থেকে নামলো পোয়েম এবং তার সাথে সম বয়সী একটা হ্যান্ডসাম ছেলে।
নীলিমা সন্দীপের দৃষ্টি অনুসরন করে বললো, "ওই হচ্ছে অভিষেক। "
সমস্ত বন্ধুবান্ধব দের সাথে আজ পরিচয়ের পালা। সন্দীপ দেখলো দুজন কে মানিয়েছে দারুন!
একটু দূরে আলোআঁধারি তে ওরা দাঁড়িয়েছিল, শ্রেয়া ও অভিষেক হাসতে হাসতে ঢুকে গেল গেটের মধ্যে। সন্দীপ বুঝতে পারলো নিজের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছে, যে হাত সে ধরেছিল সেই হাত আজ অন্য কারুর। বনবন করে মাথা ঘুরছে, সে রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল।
নীলিমা পিছন থেকে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি কি চললে ?"
সন্দীপ কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, সে উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেল! বুকের ভেতর থেকে অজস্র বিবমিষা বেরিয়ে আসছে। নাঃ সে পারলো না, মাথা ঘুরে পড়ে গেল।
* * * * * *
অ্যালবামটার দিকে তাকিয়ে ছিল শ্রেয়া। মায়ের একটা মাত্র বাঁধানো ছবি। মামারা বলে শ্রেয়া পুরোপুরি মায়ের মতো দেখতে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময়ই মা কে হারিয়েছে। কিন্তু বাবা আর বিয়ে করেননি শ্রেয়ার কথা ভেবে। বাবা কিন্তু অসম্ভব সুন্দর এক পুরুষ। এক একবার শ্রেয়ার মনে হয় কালো ব্লেজারে আর কয়েকদিনের না শেভ করা দাড়িতে বাবা কে সবচেয়ে হ্যান্ডসাম পুরুষ। কাকিমা একবার বলেছিল মা মারা যাওয়ার পর অনেকেই বাবা কে জামাই করার জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন কিন্তু বাবা আর বিয়ে করেনি। বাবা কে যেমন ভালোবাসে ঠিক ততটাই ভয় করে। একবার বাবা কে বলেছিল সন্দীপের কথা, সব শুনে বাবা বলেছিলেন, জীবন টা হিন্দি সিনেমা নয় যে বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করবে এক গরীব ছেলের সাথে। তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি সে। কারন সে খুব ভালো করেই জানে তার একমাসে যে টাকা হাত খরচ হয় সে টাকা সন্দীপ দু তিন মাসে আয় করে।
ভেবেছিল সময় সুযোগ বুঝে মামা মামী কে দিয়ে বাবার কানে তুলবে সন্দীপের ব্যাপারটা কিন্তু এমন তাড়াহুড়ো করে সব অ্যারেঞ্জ হয়েগেলো যে বলার সুযোগই পাওয়া যায়নি। ওদিকে সন্দীপ ও এক ছেলে, জাস্ট চুপচাপ করে শুনে যায় মুখে কোন প্রতিক্রিয়া নেই। শ্রেয়া খুব ভালো করে জানতো এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে জানলে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক হতো সন্দীপের, তাই ইচ্ছে করেই বলেছিল এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে গেছে। কিন্তু মাত্র দেড় মাস, এর মধ্যেই তাকে পালাতে হলো মিথ্যে চেন্নাই যাওয়ার গল্প তৈরি করে, কারন সরাসরি সন্দীপ কে সে কোনদিনও বলতে পারবে না তার বিয়ের কথা। অভিষেক ছেলে হিসেবে নিঃসন্দেহে ভালো, প্রত্যাখান করার মতো কোন যুক্তিই নেই তবুও মনের কোথাও যেন সন্দীপের জন্য জায়গা টা থেকেই গেছে।
ফোন টা বেজেই চলেছে একটানা। অভিষেক ফোন করেছে, আসলে যেভাবে পার্টি থেকে হঠাৎ করেই বেরিয়ে এসেছিল তাতে অভিষেক ফোন করতেই পারে কারন কয়েকদিন পরেই তাদের বিয়ে। পার্টি যখন খুব জমে উঠেছে ঠিক তখনই নীলিমার ফোন টা সব কিছু উলটপালট করে দিয়েছিল। অসম্ভব রাগ ধরেছিল নীলিমার উপর। যেখানে সে নিজে অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে সন্দীপের চিন্তা টা মন থেকে বার করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে সেখানে কি দরকার ছিল নীলিমার সব সত্যি কথা সন্দীপের কাছে বলে দেওয়ার। অসম্ভব রাগ ধরলেও পারেনি কিছু বলতে কারন তার পরেই নীলিমা যেটা বলেছিল সেটা শুনেই মনের সব রাগ দুঃখ দূর হয়ে গেছিল। হু হু করে ভেঙ্গে পড়েছিল নিজের ভিতর। অসম্ভব একটা যন্ত্রনা কুরে কুরে খাচ্ছিল নিজের মনের মধ্যে। সন্দীপ মাথা ঘুরে পড়ে গেছে অভিষেকের সাথে তাকে দেখে! নির্ঘাত নীলিমা ছিল তাই তাকে ধরে একটা ডিসপেন্সারি তে নিয়ে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়েছে। সেই আনন্দঘন মুহূর্ত ক্ষনিকে বিষাদে পরিনত হয়েছিল। সে শুধু অনেক কষ্টে নীলিমা কে বলেছিল সন্দীপ কে যেন সাথে নিয়ে গিয়ে ট্রেনে বসিয়ে দিয়ে আসে একটা সিট দেখে। কোনরকম বাহানা দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল পার্টি থেকে। অভিষেক পৌঁছে দিতে চেয়েছিল কিন্তু শ্রেয়া সটান অভিষেক কে না বলেছে কারন একটু কাঁদতে চায়-একাকী কাঁদতে চায়। ঘড়ির আওয়াজে চমকে উঠলো শ্রেয়া, তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্যারেজের কাছে গেল! নাঃ গ্যারেজ নয়, সোজা বেরিয়ে এলো, গেট থেকে বেরিয়ে সোজা বড় রাস্তার উপর আসতেই একটা হলুদ ট্যাক্সি দেখতে পেল। ইশারা করে দাঁড়াতেই ট্যাক্সি টা সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো।
ট্যাক্সি দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে, হয়তো এতক্ষনে পার্টি প্রায় শেষের পথে, এক এক করে অভিষেকের বন্ধু রা বিদায় নিচ্ছে। নীলিমা কি এতক্ষনে সন্দীপ কে পৌঁছে দিয়েছে স্টেশনে? সে নীলিমা কে মেসেজ করলো, "তুই কোথায়?"
নীলিমা সঙ্গে সঙ্গে রিপ্লাই করলো, "হাওড়া স্টেশনে ঢুকছি। "
শ্রেয়া তাড়াতাড়ি মেসেজ করলো, "একটু ওয়েট কর, আমি যাচ্ছি।"
রাতের কলকাতা সেজে উঠেছে আলোয়, ভ্যালেন্টাইনস ডের আবেগঘন মুহূর্তে অজস্র মন আজ ভাঙ্গছে গড়ছে। কৈখালী, চিনার পার্ক, নাগের বাজার, খান্না, শ্যাম বাজার একটার পর একটা পেরিয়ে চলেছে ট্যাক্সি টা। শ্রেয়া নিজেও জানে না কেন যাচ্ছে সে, কিসের টানে ছুটে চলেছে। হাওড়া তে ঢুকতেই তাড়াতাড়ি টাকা টা দিয়ে দৌড়ে গেল, বড় ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় রাত সাড়ে দশ টা বাজে! তাহলে ওরা নিশ্চয় ট্রেনে চলে গেছে। হঠাৎ মনে পড়লো সন্দীপ বলতো রাত দশ টা পঁয়তাল্লিশের পুরী প্যাসেঞ্জারে সন্দীপ বাড়ি যায় আর ওটা আঠারো নম্বর প্লাটফর্ম থেকেই প্রায় ছাড়ে। এক -দুই -তিন -চার একটার পর একটা প্লাটফর্ম পেরিয়ে যখন আঠারো নম্বর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালো তখন সে হাঁপিয়ে উঠেছে। এদিক ওদিক তাকালো, কেউ নেই, অজস্র মানুষ চারপাশে ট্রেনে উঠছে নামছে। ফোন টা বের করে কল করতে যাবে হঠাৎ দেখতে পেল নীলিমা দাঁড়িয়ে আছে অনেকটা দূরে জানালার পাশে। সে এগিয়ে গেল, নীলিমা ও দেখতে পেয়েছিল, শ্রেয়ার দিকে হাত নাড়লো। শ্রেয়া কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো নীলিমা কে। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এসেছে, একটু আগেই যে নীলিমা কে ফোনে বকেছিল এখন তাকেই মনে হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। তারপর হঠাৎ নজর পড়লো ভিতরে জানালার পাশে সন্দীপ বসে আছে। সে সোজা উঠে গেল ট্রেনে, সন্দীপ চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ছিল খেয়ালই করেনি কখন পোয়েম এসেছে। হঠাৎ কেউ যেন তাকে একটু সরিয়ে পাশে বসে পড়তে সন্দীপ চোখ মেলে তাকালো। বিশ্বাসই হচ্ছে না, সে ভালো করে চোখ রগড়ে আবার তাকালো! ততক্ষনে হর্ন দিয়ে ট্রেন স্পিড নিচ্ছে। সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল মুখে বলার মতো শক্তি হারিয়ে, হঠাৎ বাইরে থেকে নীলিমা বললো,"এবার আর হাত ছেড়ো না। আমি চললাম। বাই বাই।"
সে মুখ ফিরিয়ে হাত নাড়লো নীলিমার দিকে, ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করতেই নীলিমা হারিয়ে গেল দূরে। হঠাৎ খেয়াল করলো একটা শক্ত হাত তাকে জড়িয়ে ধরেছে। বিশাল প্রাসাদের মায়া ত্যাগ করে বহুদূরে এক গ্রামের পথে এগিয়ে চলেছে পাশের মেয়েটি।
ট্রেন ছুটে চলেছে। আশেপাশের সব যাত্রীরাও ঘুমিয়ে। সন্দীপ দেখল তার পাশে বসা মেয়েটিও ঘুমিয়ে পড়েছে সারা দিনের ক্লান্তিতে। হয়তো শীত লাগছে, হাত গুটিয়ে হেলান দিয়ে বুকে শুয়ে পড়েছে। সে ব্যাগ থেকে একটা শাল বার করে জড়িয়ে দিল নিজেকে এবং মেয়েটির গায়ে। বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে, মেয়েটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
সমাপ্ত
© FB.com/shyamal.majumder.39501