ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় এক শ্রাদ্ধবাসরে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেদিন ওনার সাথে তেমন আলাপচারিতা হল না। শুধু এটুকু জানলাম, ওনার নাম প্রিয়তোষ রায়, আমাদের স্টিল প্ল্যান্টের আরো কিছু কন্সট্রাকশনের দায়িত্ব নিয়ে যে নামকরা কম্পানিটি এসেছে, উনি সেখানেই কর্মরত। আরো জানলাম, প্রিয়তোষ বাবু অসাধারণ রবীন্দ্রসংগীত গান আর দুর্দান্ত কবিতা লেখেন।
আমার বাবা মা তখন ছ মাস আমার কাছে ভাইজাগে আছেন। সুতরাং এমন একটি গুণী মানুষের সাথে আমার বাবার আলাপ করানোর জন্য, ওনার গলায় গান শোনার জন্য, ওনার লেখা কবিতা শোনার অধীর আগ্রহে আমি প্রিয়তোষবাবুকে আমাদের বাড়ীতে সান্ধ্য চা পানের আসরে নিমন্ত্রণ করেই ফেললাম।পরের রবিবার গোধূলি লগ্নে আমাদের বাড়িতে প্রিয়তোষ বাবুর পদধূলি পড়ল।
স্বভূমি থেকে অতদূরে প্রবাসে বড় হয়েও যাতে নিজেদের শিকড়টা কে না ভুলে যায়, তাই বড় যত্নে আমি আমার দুই মেয়েকে বাংলা শিখিয়েছিলাম, বাংলা সাহিত্য, বাংলা সিনেমার রস গ্রহণে আগ্রহী করে তুলেছিলাম। আমার বড় কন্যা চিত্রাঙ্গদা ওরফে বাবলি আবার একটু বেশীই রাবীন্দ্রিক। রবিঠাকুরের গান ওর মজ্জায় মজ্জায়। রবীন্দ্রসংগীতের একজন সুগায়ক আসছে শুনে তার উৎসাহ কিঞ্চিৎ বেশী। কিন্তু মাত্র একমাস বাদেই বাবলির সি বি এস সি বোর্ডের পরীক্ষা। ফলে ওর দিদার কাছে প্রচুর অনুনয়বিনয়ের পর ঠিক হল, ও আমাদের ড্রইং কাম ডাইনিং রুমের খাবার টেবিলের ওখানে বসে অঙ্ক প্র্যাক্টিস করতে করতে গান শুনবে। আমার কনিষ্ঠ কন্যা মিতুল তখনো বেশ ছোটো। ও তখনো বিকেলে গান শোনার থেকে পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে বেশী আগ্রহী।
বাবা মায়ের সাথে প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পর্ব, চন্দননগর থেকে আনা সুগন্ধি দার্জিলিং চা আর জিঞ্জার বিস্কুট দিয়ে সারা হল। এবার গানের আসর বসবে। প্রিয়তোষবাবু ততক্ষণে সেন্টার টেবিলের উপর রাখা গীতবিতানখানি হাতে নিয়ে নিয়েছেন। বাবা ডিভানের উপর মেরুদণ্ড সোজা করে, জোড়াসনে বসলেন, দুচোখ বন্ধ। এটাই স্বাভাবিক। ভানুসিংহের গান বাবার কাছে পূজার মন্ত্র। সাত্যকি বসল প্রিয়তোষ বাবুর পাশের সোফায়, আমি ডিভানের ঠিক উলটোদিকের বড় সোফায়, পাশে আমার মা।
প্রিয়তোষবাবু একটু গলা ঝেড়ে নিলেন, বললেন,
"বলুন, কিরকম গান শুনবেন?"
কথাটা সঠিক বোধগম্য হল না। গীতবিতান হাতে নিয়ে ' কিরকম গান শুনবেন ' মানে? গীতবিতানে কি রবীন্দ্রসংগীত ছাড়া আর কোনো গান থাকে নাকি? ও, তাহলে উনি নিশ্চই পর্যায়ের কথা বলছেন, পূজা পর্যায়, প্রেম পর্যায়। বললাম,
"যেকোনো পর্যায়, শোনান না আপনার পছন্দ মতো।"
প্রিয়তোষ মাথা নেড়ে বললেন,
"তা বললে চলে? এক একটা গানই কত ধরনের হতে পারে, দেবব্রত, হেমন্ত, চিন্ময় --"
আমি রীতিমতো স্তম্ভিত। বলে কি? এতোজনের গলা নকল করে গাইতে পারে। এ তো জিনিয়াস। একে তো কাল্টিভেট না করলে চলছে না। সাত্যকি দেখলাম আমার হাঁ করা মুখের পানে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবা চোখ খুলে তাকালেন। একটা ভুরু ধনুকের মতো বেঁকে রইল। বাবলি অঙ্ক করা থামিয়ে আমার মতোই মুখ ব্যাদান করে তাকিয়ে আছে। একমাত্র মায়ের মুখেই কোনো বিকার নেই দেখে দু:খ পেলাম।
আমি দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্র সৌরেন দাসের কাছে গানের তালিম নিয়েছি। বাবাও তাঁর জর্জদার একনিষ্ঠ ভক্ত। সাত্যকি আর আমার প্রেমের মেলবন্ধনের প্রধান সূত্র দেবব্রত বিশ্বাস। সুতরাং ওনার গলার গানই হোক। বললাম সেকথা। প্রিয়তোষবাবু আবার গলা ঝেড়ে নিলেন। বাবাও দেখলাম আবার চোখ বন্ধ করে সোজা হয়ে বসেছেন। শুরু হল গান।
"আকাশং ভরাং, সূজ্জং তারাং, বিষং ভরাং প্রাং, তাহারিং মাঝং খানেং আমিং পেয়েছিং, আমিং পেয়েছিং ম্রোং স্থাং, বিশ্যয়েং তাইং জাগেং ----"
দেখলাম বাবা পটাং করে চোখ খুলে ছানাবড়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। সাত্যকির দৃষ্টিতেও কেমন একখানা জল্লাদের হিংস্রতা। হঠাৎ আওয়াজ হল দড়াম। কি হল? তেমন কিছু না। মা কখন আমার পাশ থেকে উঠে গিয়ে, বাবলিকে বগলদাবা করে শোবারঘরে ঢুকে গেছেন। দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করল বাবলি। তাতে কাজ হল। প্রিয়তোষ তাঁর অনুস্বর সমৃদ্ধ গান থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
"কি হল?"
বললাম,"কিছুনা। হাওয়া, হাওয়ায় দরজা বন্ধ হল।"
"আর মাসিমা?"
"মার পায়ে ব্যথা করছে বলে ঘরে শুতে গেছে।"
প্রিয়তোষ ভারী নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন,
"তাহলে আবার শুরু করি?"
দেখলাম, বাবা করুণ মুখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, ভাবখানা এই,"এ কাকে ধরে আনলি মা?"
আমি সপ্রতিভ ভাবে বললাম,
"এবার, বাবা, শুরু কর"।
বাবা বাধ্য সন্তানের মতো ধরলেন গান,
"আসনতলে মাটির পরে লুটিয়ে রব।"
বাবার উদাত্ত গলার সুরে সমস্ত বাড়ি গমগম করে উঠল। যদিও অন্যদিনের মতো আবেগ যেন একটু কম। গান শেষ হতেই বাবা নিজেই বলে উঠলেন,
"বুড়ু, এবার তোর গান শুনব।"
আমি সঙ্গে সঙ্গে দেরী না করে ধরলাম,
"আমার বিচার তুমি কর নাথ আপন করে।"
আমার গান শেষ হতেই সাত্যকি গাইল,
"নিশিদিন ভরসা রাখিস, হবেই হবে ---"
আমাদের গানের এক রাউণ্ড রিলে রেসের পর প্রিয়তোষ অভিমান ভরে বললেন,
"এবার আমি একটা গাই? আমার গান তো শুনলেন ই না।"
বাবা তাড়াতাড়ি হাল ধরলেন, বললেন,
"আরে গান তো হবেই তবে তার আগে একটু লুচি খেয়ে নেবেন না?"
প্রিয়তোষের মিয়ানো গলায় সজীবতা ফিরে এলো। বললেন,
"লুচি?"
এবার সামলানোর পালা সাত্যকির, বলল,
"লুচি, মাংস, গাজরের হালুয়া। আগে হয়ে যাক কি বলেন? দূর দূর, খালি পেটে কি আর ওস্তাদের গান জমে?"
আমি ততক্ষণে সকালের রাঁধা মাংস গরম করে, কড়ায় তেল বসিয়ে লুচি বেলতে শুরু করে দিয়েছি। মা ও চলে এসে সাহায্য করলেন। খান বারো লুচি ভেজে, টেবিলে খাবার সাজিয়ে প্রিয়তোষ কে খেতে ডাকলাম। আমার রান্নার উচ্ছসিত প্রশংসার সঙ্গে একে একে সব কটা লুচি খেয়ে নিলেন। আমার খুব কষ্ট হল, আহারে, স্ত্রী,পরিবার ছেড়ে এখানে একা একা আছেন, হয়তো খাওয়া দাওয়ার খুব কষ্ট। বাবার ইশারায় আর এক দফা চা করলাম যত্ন করে।
চা খাওয়া শেষ হতেই সাত্যকি বলল,
"দাদা, কিছু মনে করবেন না, আমাকে সুদেষ্ণাকে নিয়ে একটু কালীবাড়ি যেতে হবে, কাজ আছে, চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাই।"
প্রিয়তোষ বললেন,
"সে কি,আমার কবিতাগুচ্ছ তো শোনানোই হল না।"
আমি তখন বেপরোয়া। বললাম,
"পরে আর একদিন নাহয় শোনা যাবে। আজ তো এখন উঠতেই হবে দাদা।"
ভদ্রলোক আর দ্বিরুক্তি করলেন না। গুটি গুটি উঠে পড়লেন। আমাদের বাড়ির কাছেই ওনার ডেরা। ওনাকে নামিয়ে দুজনে সত্যি সত্যিই কালীবাড়ি পেন্নাম ঠুকে এলাম, তাই হয়তো বাড়ি ফিরে সবাই তেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল না। বুঝলাম এ যাত্রা কোনোমতে রক্ষে হল।
মাস খানেক পরের কথা। কালীবাড়িতে অ্যানুয়াল স্পোর্টস ডে। সাত্যকি অ্যাঙ্কার। আমি তো বরাবরই খেলাধুলো থেকে শত হস্ত দূরে। মিতুল আবার সব ইভেন্টে নাম দিয়েছে, আর তাই মাঠে তার মায়ের উপস্থিতি চাই ই চাই। আমি কি আর করি, দুপুরের ভাতঘুমের মায়া ত্যাগ করে অন্য সব মায়েদের সঙ্গে গাছের ছায়ায় বসে গুলতানি করছি। হঠাৎ মাঠে প্রিয়তোষের আবির্ভাব। তত দিনে আমার কল্যাণে আমাদের বাড়িতে এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে ওনার নামের কিছু অদলবদল হয়েছে,"প্রিয়মোষ"। সংক্ষেপে"মোষ"।
আমার বন্ধু রিনি আমায় বলল,
"নাও সুদেষ্ণাদি, তোমার ' মোষ ' এসেছে। দ্যাখো দ্যাখো তোমায় খুঁজছে বোধহয়। হি হি"
মাথার কাউবয় টুপিটা একটু নামিয়ে মুখ ঢাকলাম। হা হতোস্মি। মুখ ঢাকলে কি হবে, এ বিশাল বপু আমি লুকাবো কোথায়? মোষ ঠিক দেখেছে আমায়, কাছে এসে বললেন,
"একটু এদিকে আসবেন? সেদিন তো শোনানো হলনা, তাই আজ সাথে করে নিয়ে এসেছি, আমার কবিতাগুচ্ছ।"
কি আর করি, উঠতেই হল, খানিক দূরে গিয়ে পকেট থেকে কয়েকটা হরেক কিসিমের বিল বার করলেন প্রিয়তোষ। বুঝলাম, কাজের ফাঁকে ফাঁকে হাতের কাছে যা পেয়েছেন তাতেই লিপিবদ্ধ করেছেন মনের অবরুদ্ধ আবেগ। মায়া হল, বললাম,"শোনান, শুনি।"
বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে কবিতা পাঠ আরম্ভ হল। আমি মাইকে আমার পতি দেবতার সরস সঞ্চালনার শব্দরাশি থেকে কোনোমতে নিজের কান বাঁচিয়ে প্রিয়তোষের কবিতায় মন দিলাম। কিন্তু একি? একি কবিতা রে বাবা? প্রতি ছত্রে কোনো এক মনোমোহিনীর রূপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আর তার কামনায় অধীর হৃদয়ের আকুলতা, তাকে কাছে পেয়ে তাকে ---। আমি আর পারলাম না। আমি অত আধুনিকা নই, কবিতাও কিছু কম বুঝি। এরকম রগরগে ভাষার নীলাভ বিষয়বস্তু স্রষ্টার মুখ থেকে শুনে হজম করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম,
"কি পড়ছেন বলুন দেখি, কিছুই তো শুনতে পাচ্ছি না। এভাবে কি কবিতা শোনা যায়? পরে শুনব।"
খোঁড়া পায়ে প্রায় দৌড়ে আমার বন্ধুদের মাঝে এসে বসলাম। দেখলাম, সাত্যকিও এদিকেই আসছে। ও কাছে আসতেই, আর্ত স্বরে বললাম,
"বাঁচাও। যদি অগ্নিসাক্ষী করে, ঠিকঠাক মন্ত্র বলে আমায় বিয়ে করে থাকো, তবে তোমার স্ত্রীকে মোষের কবিতা থেকে বাঁচাও। এইমাত্র ভাত খেয়ে এসেছি, সব বমি হয়ে যাবে।"
শুনে সাত্যকি আর দাঁড়ালো না। ফিরে গিয়ে মাইকে ঘোষণা করল,
"এখন আমাদের মধ্যে পেয়েছি বিখ্যাত কবি প্রিয়তোষদাকে। উনি বাচ্চাদের চকলেট দিয়ে আমাদের ধন্য করবেন।"
বলে, দেখলাম চকলেটের ঠোঙাটা কার হাত থেকে নিয়ে ওনার হাতে ধরিয়ে দিল, উনিও গদগদ মুখে ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের হাতে হাতে চকলেট বিতরণ শুরু করে দিলেন। সেদিন মিতুলের খেলা শেষ হতেই, আমি আমার স্কুটি নিয়ে পালিয়ে এলাম, প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন অব্দি আর থাকা হল না।
সেবার পঁচিশে বৈশাখ, আমি ঠিক করলাম, আমি আবার নৃত্য পরিচালনার ভার নেব। প্রায় আট বছর পর আমার এই সক্রিয় অংশগ্রহণে কালীবাড়ির সবাই খুব খুশী। সবচেয়ে খুশী কুচোকাঁচার দল। কারণ আমার পরিচালনা মানেই সেখানে খোকা খুকু নির্বিশেষে সকলের প্রবেশাধিকার। নাচতে না জানলেও পরোয়া নেই, পিসীমণি তাদের শিখিয়ে নেবে। অতি উৎসাহে কালীবাড়ির তদানিন্তন প্রেসিডেন্ট প্রলয় তো অফিসার্স ক্লাবের হলই বুক করে ফেলল, সে এক বিরাট খরচের ব্যাপার।
প্রিয়তোষদের কোম্পানির ই এক বড় কর্তা শ্রদ্ধেয় অনীশদা যাঁর সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা পরে আত্মীয়তায় স্থায়িত্ব লাভ করে, সত্যি সত্যিই এক বিরাট প্রতিভাধর ব্যক্তি। তাঁর ধমনীতে নীলরক্ত বইলেও তিনি বিপ্লবী পিতার সন্তান। প্রখর ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই অনীশদা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। অসম্ভব ভালো কবিতা লেখেন, অসাধারণ ছবি আঁকার হাত, এখন এই পঁচাত্তর বছরে পা রেখেও অপূর্ব গানের গলা, কারোর কাছে না শিখেও কী ভালো তবলা বাজান। তাঁর কর্মদক্ষতার জন্য ওঁদের কোম্পানী এই একবছর আগে অবধি অনীশদাকে কর্মজীবনে বেঁধে রেখেছিলো। এহেন অগ্রজ যখন আমাদের অনুষ্ঠানের কাণ্ডারী হয়ে এগিয়ে এলেন, তখন আমি বড় নিশ্চিন্ত হলাম।
ঠিক হল রবিঠাকুরের প্রতিটি আলেখ্য থেকেই কিছু অংশ নেওয়া হবে। আমি একমাস আগে থেকেই নাচের রিহার্সাল শুরু করে দিলাম। একেবারে তিন বছরের কুচো থেকে চল্লিশ বছরের মধ্য বয়সী, সব মিলিয়ে পঁয়তাল্লিশ জন নাচব। সময় লাগবে তালিম দিতে। আর আমার অনুষ্ঠান নিখুঁত হওয়া চাই। সমস্যা শুরু হল গানের মহড়ায়। যদিও অনীশদার পরিচিত একটি মেয়ে তার সুলোলিত কণ্ঠ নিয়ে আমাদের গানের দলে যোগ দিল, এবং ইতিপূর্বেই আমাদের গানের দল টি যথেষ্ট মজবুত ছিল, কিন্তু ঝামেলা হল পুরুষ কন্ঠ নিয়ে, একে সংখ্যায় কম, তার উপর তাঁরা সবাই বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে আছেন। ফলে রিহার্সালে আসার তাঁরা সময়ই পাচ্ছেন না। সম্ভবত স্টেজেই হয়তো সবাই মিলে একবার উপস্থিত হতে পারবেন। এ অবস্থার অভিজ্ঞতা আমার আগেই ছিল বলেই এর আগে আমি গানের জন্য সিডি ব্যবহার করতাম, কিন্তু এবার অনীশদার খাতিরে আবার আমরা সমবেত হয়েছি, এবং প্রতিদিন ওনার হতাশাই বাড়ছে শুধু।
এরকমই একদিন অনীশদা আরো একটি দু:সংবাদ বয়ে আনলেন। প্রিয়তোষ নাকি কার সুপারিশ নিয়ে এসেছে, ওকে গান গাইতে দিতেই হবে। সবাই প্রথমটা আমার বিরক্তির কারণ ঠিক বুঝতে পারলো না। বুঝল যেদিন প্রিয়তোষ এসে ওনার সেই বিখ্যাত"অং কি মাত্রায়"ভূষিত গান গাইলেন। এদিকে উনি আবার প্রচণ্ড সিরিয়াস, প্রতিদিন মহড়ায় আসেন। বেচারি অনীশদার ই যেন গুরু দায়িত্ব, এই বেয়ারা শিষ্যটি কে গড়ে পিঠে নেওয়া। প্রতিদিনের অভ্যাসে গলা কিঞ্চিৎ সুরে এল বটে কিন্তু ঐ অনুস্বর ঠিক বহাল রইল।
পঁচিশে বৈশাখ এলো। আমি ভীষণ ব্যস্ত আমার নাচের পল্টন সামলাতে। সকলের সাজসজ্জা শেষ হল, ড্রপসিন উঠল। সাত্যকি যেহেতু সঞ্চালনায়, ওর হাতে একটি স্বতন্ত্র কর্ডলেস। উদ্বোধন সংগীত শুরু হতেই খুব অবাক হলাম, কই? মোষের অং বং শোনা যাচ্ছে না তো। উইংসের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, স্টেজের শেষ ভাগে ঘেরা অংশে যেখানে গানের দল বসেছে, তার এক্কেবারে পিছনে এককোণে মোষের বসার ব্যবস্থা করেছেন অনীশদা। সেখানে মাইক ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বেচারি গানে লিপ দিচ্ছে শুধু।
এল শ্যামা পর্ব। এবার কি হবে? প্রিয়তোষের উত্তীয়ের গলায় তো দুইখান সোলো আছে, মাইক তো ওঁকে এখন দিতেই হবে। আমার খুব ভয় করতে লাগল, উত্তীয়ের ভূমিকায় নাচছে যে মেয়েটি তার বাবা সমীরদা তাঁর নিকন ক্যামেরায় মেয়ের নাচের ভিডিও তুলছেন, শুনেছি এককালে ভালো বক্সার ছিলেন। খুব গান পাগল অথচ মাথা গরম মানুষ। মোষের গান শুনে শেষমেশ স্টেজে উঠেই না প্রিয়তোষের নাকে একখানা গদাম করে ঘুঁষি চালিয়ে দেয়। দৃশ্যটা কল্পনা করে আমি একবার কেঁপে উঠলাম।
দেখলাম, কোটাল, বাল্মীকির দস্যু সর্দারের গায়ক হুতাশনদা বোধহয় পা ছাড়াতে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এই এক ভদ্রলোক, যেমন পণ্ডিত তেমনি গানের গলা। গীতবিতানের সব গানই বোধহয় মুখস্থ। উনি রিহার্সালে আসার তেমন সুযোগ ই পাননি, তাতে কিচ্ছু অসুবিধে হচ্ছে না। উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে হুতাশনদা থমকে গেলেন, কারণ প্রিয়তোষ তখন আবেগভরে গাইছেন,
"আমারং জীবনং পাত্রং উচ্ছলিয়াং মাধুরীং ক্রেছং দাং"
ব্যস। ঐ এক লাইন অব্দি, তারপর এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল। হুতাশনদা প্রিয়তোষের মাথায় চটাং চটাং করে দুখানা চাঁটি মেরে, হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে বাকি গানটা সাবলীলভাবে গেয়ে চললেন। প্রিয়তোষ বেচারা মাইক ধরার জন্য উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছে, হুতাশনদা গানের এতোটুকু সুরবিচ্যূতি না ঘটিয়ে তাঁর বলিষ্ঠ বাঁহাতে মোষের ঘাড় চেপে ধরে রাখলেন গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত। প্রিয়তোষ খানিক মাথা নীচু করে বসে থেকে ওখান থেকেই উঠে এলেন। আমি স্টেজের পিছন দিকে লুকিয়ে শুনলাম, হুতাশনদা একাই অক্লেশে গায়কী পালটে একবার কোটাল, একবার উত্তীয়ের গান গেয়ে যাচ্ছেন।
কিন্তু আমি আর কতক্ষণ লুকিয়ে থাকব? এর পরেই চণ্ডালিকা। তাতে প্রকৃতির মায়ের ভূমিকায় আমি। উইংসের পাশে এসে দাঁড়াতেই প্রিয়তোষ আমায় চেপে ধরলেন, চোখে জল, বললেন,
"শুধু আপনার জন্য গাইতে এসে আমায় কি অপমানটাই না সইতে হল। জানেন আমায় মেরেধরে ঐ লোকটা মাইক কেড়ে নিল, অনীশদাও কিচ্ছু বললেন না। আচ্ছা আমিও দেখে নেবো। জানেন, কলকাতায় কত জায়গা থেকে আমায় এই উত্তীয়ের খেপ খাটতে মানে গাইতে ডাকে। আমাকে এত্তোবড় ইনসাল্ট?"
বললাম,"কি বলব বলুন, এমনটা যে হবে আমি কি জানতাম? পরে এ নিয়ে আমি হুতাশনদার সাথে আপনার হয়ে নিশ্চয়ই ঝগড়া করব। কিন্তু এখন যে আমার সিন আছে, আমায় যেতে হবে।"
অনুষ্ঠান শেষে প্রিয়তোষকে কোথাও দেখতে পেলাম না। কিন্তু ওনাকে দেওয়া আমার কথা রাখতেই, হুতাশনদাকে একটু খুন্ন গলায় বললাম,
"এটা কি ঠিক হল হুতাশন দা? ভদ্রলোককে তুমি একেবারে চাঁটি মেরে বসলে?"
হুতাশনদা ঝাঁঝালো গলায় বলল,
"বেশ করেছি, চাঁটি মেরেছি, ' আমারং জীবনং পাত্রং? গলা টিপে একেবারে ওটাকে যে চন্দ্রবিন্দু বানিয়ে দিইনি এই ওর বাপের ভাগ্যিং জানবি।"
অত:পর আর কি বলব বুঝলাম না।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আমি চিরকালই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে ওস্তাদ। তখন আমি কালীবাড়িতে অবৈতনিক বাংলা পাঠশালা খুলেছি, প্রতি শনিবার ক্লাস হয়। ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা নেহাৎ মন্দ না। তারা কতটা মাতৃভাষা শেখার তাগিদে আসে আর কত টা তাদের এই পিসিমণির গল্পপাঠ শোনার লোভে আসে বলা শক্ত। অবশ্য মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই আমার ক্ষুদে সেনারা লিখতে পড়তে শিখে আমাদের"কথা"পত্রিকায় দিব্য গল্প কবিতা লিখে ফেলেছিল। সেখানে আমার সত্যিই তেমন কৃতিত্ব নেই কিন্তু। আমি শুধু ভালো ভালো গল্প বলে বলে ওদের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহটা তৈরী করার চেষ্টা করেছিলাম মাত্র।
বরাবরের কালীভক্ত সাত্যকি প্রতি শনিবার আমায় সন্ধ্যাবেলায় কালীবাড়িতে নিয়ে আসত, তখন মন্দির কমিটিতে সাত্যকিও ছিল, ফলে ঐ দেড় দুঘণ্টা মায়ের আরতি দেখে, অন্য কমিটি মেম্বারদের সঙ্গে গল্পগাছা করে ওর দিব্য কেটে যেত। একদিন সাত্যকি আমায় ওখানে পৌঁছে দেবার পরই মোবাইলে খবর পেলো, প্ল্যান্টে কি গণ্ডগোল হয়েছে। এ জি এম পার্সোনেল সঙ্গে সঙ্গে ছুটল প্ল্যান্টে, আমায় বলে গেলো আমার পড়ানো শেষ হলে, প্রলয় ওর গাড়িতে আমায় বাড়ি পৌঁছে দেবে। প্রলয় আমাদের কয়েকটি বাড়ি পরেই থাকে। ওর স্ত্রী রিনি আমাকে বড় দিদির মতো দেখে।
আমার পড়ানো শেষ হয়ে গেছে, এবার গল্প বলার পালা, হঠাৎ দেখি প্রিয়তোষ লাইব্রেরীর আমার পাঠশালায় ঢুকে পিছনের দিকে একখানি চেয়ার নিয়ে বসে পড়লেন, ঘরে ঢোকার আগে আমার অনুমতি নেওয়ার ও প্রয়োজন বোধ করলেন না। আশ্চর্য তো? আমার পড়ুয়াদের অনেকের বাবা মা এসেই বাইরে অপেক্ষা করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকের সাথেই আমাদের নিত্য ওঠাবসা, তাঁরা তো কোনোদিন এমন করেননি। আমি প্রচণ্ড বিরক্তি বোধ করলাম। লীলা মজুমদারের একখানা জমাটি গল্প শোনালাম বটে, কিন্তু মোষের বারবার অনর্থক প্রশ্নে ক্রমশ আমার মেজাজ খিঁচড়ে যাচ্ছিল, আমি অন্যদিনের মতো গল্পপাঠে আমার গলাকে ঠিক ঠাক ব্যবহার করে শ্রোতাদের মন যেন ঠিক ছুঁতে পারলাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
প্রলয়ের গাড়িতে উঠব। প্রিয়তোষ দৌড়তে দৌড়তে এসে প্রলয় কে ভারী বিনয়ের সাথে অনুরোধ করলেন ওনাকে যদি বাড়িতে ড্রপ করে দেওয়া হয়।
প্রলয় তার জলদগম্ভীর গলায় আদেশ করল,
"সুদেষ্ণা তুমি পিছনে বস। প্রিয়মোষবাবু আপনি সামনে আমার পাশে বসুন।"
প্রিয়তোষ খুব আহত গলায় বলল,
"আমার নাম প্রিয়তোষ, প্রিয়মোষ নয় ভাই।"
"ঐ একই হল। নামের আগে প্রিয় আছে তো সে তোষ ই হোক বা মোষ।"
বলে, আমায় ছোট্ট করে একটা চোখ মেরে এক চিলতে হেসে নিল, মোষ দেখতে পেলেন না।
গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে, প্রলয় বলল,
"সুদেষ্ণা তালাত মামুদ শুনবে, চালাই?"
সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়তোষ বললেন,
"কিচ্ছু চালাতে হবে না। এইটুকু পথ আমিই আপনাদের গান শুনিয়ে দিচ্ছি।"
রাগে গা জ্বলে গেল, লোকটা বলে কি? আমি ওনাকে থামানোর আগেই মোষ শুরু করলেন,
"এইং পথং যদিং না শেষং হয়ং তবেং কেমং হতোং তুমিং বলং তোং"
প্রলয় আচমকা বলল,
"সুদেষ্ণা চেপে বস।"
তারপর দেখলাম প্রলয় তার স্যান্ত্রোর স্পিড ভয়ংকর রকম বাড়িয়ে দিল। মোষ সভয়ে গান থামাতেই গাড়ির স্পিড ও কমে গেল। প্রিয়তোষ আবার নতুন উৎসাহভরে যেই শুরু করল,"এইং পথং", সঙ্গে সঙ্গে অ্যাক্সিলারেটরে আবার প্রবল চাপ। প্রিয়তোষ এবার আর পারলেন না, জিজ্ঞেস করেই ফেললেন,
"আপনি এমন কেন করছেন বলুন দেখি?"
প্রলয়ের উত্তর যেন তৈরীই ছিল,
"বা: আপনি গাইলেন না, এই পথ যদি না শেষ হয়, ভাবলাম আপনার বাড়ি যাওয়ার তাড়া আছে বুঝি, বুঝলে তো সুদেষ্ণা?"
বললাম,"বিলক্ষণ।"
"তাহলে অন্য একটা গান ধরি?"
প্রিয়তোষের নিষ্পাপ জিজ্ঞাসা। প্রলয় কড়া গলায় বলল,
"দেখুন প্রিয়মোষবাবু --"
"মোষ নয় তোষ",
প্রিয়তোষ কাতর কন্ঠে বললেন, প্রলয় তাতে পাত্তা না দিয়ে বলল,
"ঠিক আছে তোষ, তা তোষবাবু, শুনুন, আপনার গান শুনে আমার গাড়ির কিছু একটা ব্যামো হয়েছে, আপনা আপনি স্পিড বেড়ে যাচ্ছে, বুঝলেন কিনা। তাই অনুরোধ করছি উপরে যাওয়ার বিশেষ তাগাদা না থাকলে একদম চুপটি করে বসুন। খবরদার, গান গাইবেন না কিন্তু।"
ভদ্রলোক বাকি পথ আর কথাই বললেন না। প্রলয় সেদিন আমাকে আগে বাড়ি পৌঁছে দিল। আশাকরি সেদিন তারপরে আর ওকে স্পিড বাড়াতে হয়নি।
প্রায় মাস ছয়েক পরে একদিন মঙ্গলবারের হাটে প্রিয়তোষের সাথে দেখা। শুনেছিলাম, উনি আমাদের মহল্লার এ টাইপ কোয়ার্টার ছেড়ে ওনাদের গেস্টহাউসে গিয়ে উঠেছেন, কিন্তু সেখানে ও বিস্তর গোলমাল পাকিয়েছেন।
আমি আর সাত্যকি ওনার দৃষ্টি এড়িয়ে কেটে পড়ার ধান্দায় ছিলাম। হল না। প্রিয়তোষ আমাদের সামনে এসে একটু বাঁকা হেসে বললেন,
"কি, আমাকে দেখে পালাচ্ছিলেন তো, ঠিক ধরেছি। আপনাদের আর পালাতে হবে না, এবার আমিই পালাচ্ছি আপনাদের ছেড়ে কলকাতায়, দূর দূর এখানে কোনো ভদ্রলোক থাকে? জানেন আশেপাশের ফ্ল্যাট থেকে আমার নামে কোম্পানির কাছে কমপ্লেন করেছে। আমার অপরাধ কি? না ভোরবেলায় উঠে রোজ গান প্র্যাক্টিস করি। ক'টা কুকুর নাকি ঐ সময় বেদম চিল্লায়। তা আমি কি করব। কুত্তা চিল্লায়, কুত্তাকে ঠ্যাঙা, তা না যত ঘাটের মড়া আমার পিছনে লেগেছে।"
আমি কুকুর চেঁচায় শুনে খানিক নিশ্চিন্ত হলাম, আমার কাছে অন্য খবর ছিল কি না। টাউনশিপে নাকি আজকাল আবার প্রচুর গাধা দেখা যাচ্ছে আর তারা ঐ গেস্ট হাউসের"ইর্দগির"ঘোরাঘুরি করে। যাঃ। কে যে কিসব গুজব রটায়। আমি নরম সুরে বললাম,
"ভালোই তো। স্ত্রী কে, ছেলেমেয়ে ছেড়ে কতদিন আছেন, সবাইকে আবার কাছে পাবেন।"
"স্ত্রী? জানেন না আমার স্ত্রী তিনবছর হল গত হয়েছেন, আমার কোনো সন্তান নেই, তাই তো বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াই। কিন্তু কাউকে কি আপন ভাবার উপায় আছে? কাকে আর বলছি ! আপনারাই তো আমার গান শুনে আমায় তাড়িয়ে দিলেন, হুতাশনবাবু তো যা করলেন, আমি জীবনে ভুলবনা। আর সেদিন আপনাদের বন্ধু প্রলয়বাবু অব্দি কেমন ব্যাভার করলেন? ভাবেন কিছু বুঝি না? সব বুঝি। আসলে কি বলুন তো, আমার মতো শিল্পীর আপনারা কদর করতেই জানেন না। যত সব আনকালচার্ডের দল। হু:।"
বলে, আমাদের একটি কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেলেন প্রিয়তোষ রায়।
সমাপ্ত
© FB.com/sudeshna.chakraborty3