বেলা বেড়ে চলেছে। তবু কারো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল বলে গিয়েছিল বুলু, তার ফিরতে বেলা হবে। বুলুর বাড়ি গ্রামে। অনেক দিন ধরে তাদের বাড়িতে কাজ করে। অনেক দিন পর নিজের গ্রামের বাড়িতে গেছে। সুবির মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়েছিলেন। দরজা খুলে ঘরে ঢোকেন। চারদিক কেমন নিস্তব্ধ! বেলা অনেক হয়েছে। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। অন্যদিন আরো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরেন। আজ মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার পথে দেখা হয়ে যায় পরেশের সাথে। বেশ অমনি দুজনে বসে পড়েন চায়ের দোকানে। আধঘন্টা ধরে অনেক গল্প জুড়ে দেন। তারপর সোজা বাড়ির পথে হাঁটা দেন। ঘরে ঢোকেন। কি ব্যাপার! বুলুর আজকে এতক্ষণে তো ফিরে আসার কথা। এখনো ফেরেনি বোধহয়। বারান্দায় বসে ডাক দেন, কই কোথায় আছো, আমার চা দিয়ে যাও। পাঁচ মিনিট বসে থাকার পরও সৌদামিনী চা নিয়ে এলো না। মনে কেমন সন্ধেহ জাগে! রান্নাঘর থেকে কোনো আওয়াজও তো ভেসে আসছে না! তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ছুটে যান। কেউ নেই! তবে, সৌদামিনী কোথায়! শোবার ঘরে গিয়ে দেখেন, সৌদামিনী এখনও ওঠেনি। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে আছে। এত দেরি পর্যন্ত তো ও কখনো ঘুমায় না। শরীর অসুস্থ থাকলেও উঠে পড়ে। ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যান বিছানার দিকে। সৌদামিনী গায়ে হাত রাখতেই চমকে যান ।গা বরফের মতো ঠান্ডা! তাড়াতাড়ি নাড়ি দেখে। না, নাড়ি চলছে না! সৌদামিনী নেই! শেষ! সব শেষ হয়ে গেছে! গতকাল রাতে ওর শরীর ভালো ছিল না। বুকে ব্যাথা হচ্ছিল। একটা ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর ওঠে নি। ভোরবেলায় তিনি যখন মর্নিং ওয়াক করতে যান তখনও ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। তার মানে সৌদামিনী রাতেই মারা গেছে। অথচ তিনি তো পাশেই অঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন। একটুও টের পান নি। সৌদামিনী কি তাকে শেষবারের মতো ডাক দিয়েছিল, তাকে কিছু বলতে চেয়েছিল! তিনি তো ঘুমিয়ে ছিলেন, তাই হয়তো শুনতে পাননি। সৌদামিনী এভাবে চুপচাপ চলে গেল। তাকে একা রেখে চলে গেল। সৌদামিনীর কত শখ, কত সাধ অপূর্ণই থেকে গেল। মাঝে মাঝেই অভিযোগ করতো। ওর বেড়ানোর খুব সাধ ছিল। এখানে যাবো, ওখানে যাবো বলে মাঝে মধ্যে বায়না করতো। বয়স তো পঞ্চাশ পেরিয়ে গিয়েছিল কিন্তু স্বভাব একেবারে বাচ্চাদের মতো! যখন যা মনে হতো বলে ফেলতো। ঝগড়া করতো কিন্তু রাগ বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারতো না। হেসে ফেলতো। কেমন যেন একাকীত্ব গ্রাস করতে আসছে! ধপাস করে মাটিতে বসে পড়েন সুবিরবাবু। ছেলেরা আসে। শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। ডাক্তারের অনুমান হার্ট ফেল্ করে মারা গেছে। সকলে কাজ শেষে চলে যায়। ঘর একেবারে ফাঁকা হয়ে যায়। বুলু খুব কেঁদেছে। মা চলে গেলেন অসময়ে। আমি শেষ দেখা করতে পেলুম না। তিনি বুলুকে শান্ত করেন। জীবনটা কেমন থমকে গেছে! সৌদামিনী কে তেমন যেন গুরুত্ব দিতে পারেন নি। হয়তো দেন নি ইচ্ছে করেই। অল্প শিক্ষিতা গ্রামের মেয়ে। সৌদামিনী'র খুব শখ ছিল বিয়ের পর একবার দুজনে একসাথে বেড়াতে যাবে। গিয়েছিল তবে একদল মানুষের সাথে। তাও বিয়ের দশবছর পরে। সৌদামিনী নিজের সব সুখ-দুঃখের কথা স্বামীকে বলতে ভালোবাসতেন কিন্তু সুবির সে সব শুনতে চাইতেন না। বিরক্ত হতেন। সৌদামিনীও রেগে যেতো। খুব ঝগড়া করতো। সত্যি বাড়িটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। সৌদামিনী পুরো বাড়িটা জমজমাট করে রাখতো। তার হাঁক-ডাক, হাসি, ঝগড়াতে পুরো বাড়ি মেতে থাকতো। সুবিরবাবু এজন্য তাকে অনেক বকাবকি করতেন। তুমি এত কথা কেন বলো! চুপচাপ থাকতে পারো না! আজ সারা বাড়ি চুপচাপ! সৌদামিনী তার কথার ঝুলি নিয়ে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছে! আজ সৌদামিনী কে খুব মনে পড়ছে। সৌদামিনী যতদিন বেঁচে ছিল তার কদর বোঝেন নি। তাকে যোগ্য মর্যাদা দেন নি। তার প্রতি অনেক অবিচার করেছেন। তার শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়েছেন। তাকে একটুও সময় দেননি। সে শুধু স্বামীর দিকে চেয়ে থেকেছে। স্বামীর ইচ্ছার অপেক্ষায় রয়েছে! একটা কথা খুব সত্যি যে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা নেই! কেউ এটা বোঝে না। বুঝতেও চায় না। আজ সুবিরবাবু সৌদামিনীর অভাব বোধ করছেন। সৌদামিনী তার কত অপূর্ণ সাধ -আল্হাদ নিয়ে চলে গেল! আফসোস হয়! কিন্তু আর তো কোনো উপায় নেই! অনুশোচনা ছাড়া তো আর কোনো পথ নেই।
সমাপ্ত
© FB.com/nurjahan.khatun.92167