বাবার রাত সাড়ে বারোটায় হঠাত একটা মেজর অ্যাটাক। মেয়ে নয়না তো দিশেহারা হয়ে পরে, কাকে ডাকবে কী করবে, কিচ্ছু বুঝতে পারে না। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য বসে থাকা যাবে না, অগত্যা পাশের বাড়ির অতুল কাকুর গাড়িটা দেওয়ার জন্য বলতে গেলেন নয়নার মা। এত রাতে ওনাকে দেখে অতুলবাবু ঘুম ভাঙা চোখে বললেন- বৌদি, গাড়িটা তো সার্ভিসিং এ। আপনি বরং অন্য ব্যবস্থা করুন।
অথচ আজ বিকেলেই গাড়িটা উনি গ্যারেজে দেখেছেন। নিজেকে অসহায় মনে হয় ভীষণ। হঠাত 'কাকীমা আমি আর বিল্টু বাইকে নিয়ে যাচ্ছি কাকুকে, বিল্টু পেছনে ধরে বসবে, আর তো কোনো রাস্তা নেই। কাকুকে হসপিটালে পৌঁছে বাইকটা পাঠিয়ে দিচ্ছি বিল্টুকে দিয়ে, ও তখন নিয়ে যাবে আপনাদের।'
নৃপাদেবী দেখছেন, ছেলে দুটো কী তৎপরতায় তাঁর স্বামীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। এদেরকেই কত গালমন্দ করেছেন, পুজোর চাঁদা দেওয়ার সময়। সেই বিপদের সময় কাজে এল এই রকবাজগুলোই।
*****
কলেজে সবার হার্টথ্রোব অনীশ চৌধুরী। বড়োলোক বাবার একমাত্র সন্তান। পোশাক পরিচ্ছেদেই নিজের স্ট্যান্ডার্ড বুঝিয়ে দেয়। দেবস্মিতা বরাবর এইরকম ছেলেগুলোকে এড়িয়ে চলে। দুদিন আগে এই অনীশই ওকে প্রপোজ করে, উত্তরে মুখের ওপর না বলে দেয় দেবস্মিতা। নিজের মেল ইগো আঘাত পাওয়ায় এত সহজে ছেড়ে দেবে না সেটা জানত ও।
আজ ফিরতে বেশ রাত হয়েছে টিউশন থেকে, পাড়ায় ঢোকার একটু আগে থেকেই রাস্তাটা বেশ অন্ধকার আর ফাঁকা থাকে। অনেকক্ষণ ধরেই দেবস্মিতা বুঝতে পারছে কেউ একজন ওকে ফলো করছে। নিজের গতি যত সম্ভব বাড়িয়ে দিলেও অনাহুত ভয় গ্রাস করছে ওকে।
আচমকা শুনতে পেল 'কী কাকা, আমাদের পাড়ায় ঢুকে, পাড়ারই মেয়ের পেছনে লাগা হচ্ছে?'
-'না না, কই, আমি তো....
আমতা আমতা করতে থাকা গলাটা যে অনীশের বুঝতে সময় লাগলনা দেবস্মিতার।
হঠাত একটা সপাটে চড়ের আওয়াজ পেল। তাকিয়ে দেখল পিকলু শাসাচ্ছে 'মেয়েদের পেছনে পেঁয়াজি করতে যেন আর না দেখি'।
কোনোরকমে পেছনে দৌড়াল অনীশ।
-সাবধানে বাড়ি যা দেবী, কোনো সমস্যা হলে বলিস।
কতদিন পর পিকলুর মুখে নিজের ডাকনামটা শুনল দেবস্মিতা। ছোটবেলায় একসাথে কত খেলেছে, তারপরে নাইনে দুবার ফেল করে একটা দোকানে কাজে ঢুকে গেল ছেলেটা, পাড়ার চায়ের দোকানে সকাল সন্ধ্যে আড্ডা দিত।
মা কতবার বলেছে 'দেবী, এই রকবাজগুলোর থেকে সাবধানে থাকবি'।
এই রকবাজটাই আজ কত বড়ো ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাল ওকে।
*****
'এই ছেলেগুলো সত্যি! নিজের কোনো কাম কাজ নেই, সারাদিন মাথায় স্পাইক আর হাতে বাইক নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।' রকে বসে আড্ডা দেওয়া ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন শ্রীজিতবাবু। ওদের মধ্যেই কণিশ বুঝতে পারে, বেশিরভাগ কথায় ওকে শুনিয়ে বলা। যেহেতু ওনার ছেলে আর কণিশ একই ক্লাসে পড়ত। সে ছেলে এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত।
বছর তিনেক পর-
-'কণিশ, আজ আমার ওষুধটা এনে দিবি বাবা?'
-'বাজারের থলের সাথে আছে, দিচ্ছি। সকালেই এনে রেখেছি।'
শ্রীজিতবাবু গত দুবছর হাঁটুর ব্যাথায় প্রায় শয্যাশায়ী। ছেলে তিনবছর হল বিদেশে সেটেলড্। মাস গেলে বাবার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা পাঠিয়ে দেয়।
বাড়ির বাজার থেকে শুরু করে ঠিক সময়ে ওষুধ খাওয়ানো, সবটাই কণিশ নিজে হাতে করছে।
মাঝে মাঝে চোখে জল আসে শ্রীজিতবাবুর এই রকবাজ ছেলের জন্য।
*****
রোজ রাতে মদ খেয়ে এসে বৌকে পেটায় রতন মিস্ত্রি। বৌ রাত হলেই ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। বাইরের কাউকে বলতেও পারে না লজ্জায়। এমনিতেই বাড়ির বাইরে বেরোলে রতন ভীষণ মাথা গরম করে। মাঝে মাঝে তো ক্লাবের ঐ হাতে উলকি করা, মাথায় ফেটি বাঁধা, চুলে রঙ করা ছেলেটাকে নিয়ে কাদা ছেটায় রতন নিজের বৌয়ের ওপর।
সেদিন রাতে রতন মারতে মারতে প্রায় আধমরা করে ঘর থেকে বের করে দেয় বৌকে। সারারাত অচেতন হয়ে পড়েছিল মেয়েটা। ভোরবেলায় ক্লাবের ছেলেরা দেখতে পেয়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ক্লাবঘরে রেখেছে। সকালের দিকে জ্ঞান ফিরলে ঐ উলকি করা ছেলেটাই বলল- 'দিদি, ক্লাবের ঘরদোর পরিষ্কার আর যেকোনো অনুষ্ঠানে রান্নার কাজ, পারবে তো? মাইনে দেব মাসে, ক্লাবঘরেই থাকবে। দেখছি রতন তোমার কী করতে পারে।'
আজ ছমাস হল মেয়েটা ক্লাবের হেড দিদি। সবাই ওর কথা শুনে চলে। ক্লাবটা এখন শুধু ক্যারাম পেটানোর জন্য নয়, সমাজের অনেক সেবামূলক কাজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
রতন রোজ কাজে যাওয়ার সময় মাথা নিচু করে দেখে ওর বৌটা কী ভালো আছে ঐ রকবাজ ছেলেটার দৌলতে।
সমাপ্ত
© FB.com/me.shrabana