এতদিনে শান্তি পেলাম। সারাটা জীবন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মধ্যে কেটেছে। কি অপমানটাই না সহ্য করতে হয়েছে! আজ শান্তি। সব অপমানের হিসেব মিটেছে আজ।
ভাবছেন কী যা তা বলছি? সে আপনারা ভাবতেই পারেন। আমি জানি আপনাদের কেউ কেউ নিজেদের খুব উঁচু মনে করেন....নিজেদের সম্পর্কে মনে মনে একটা কেমন ইয়ে ইয়ে ভাব আছে। জানি জানি।
এই তো আমাদের এলাকার কেষ্টটা....নিজেকে খুব বড় মনে করত। করত কেন বলছি, করে। পয়সা টয়সা ভালোই করেছে। কেমন করে করেছে সেটা আর কেউ না জানুক, আমি বা আমরা ভালো করেই জানি। আমরা বলতে...কালু, লালু, টম, তুফান, চমচম আর আমি পটলা। আমরা সারা পাড়াটা চষে বেড়াতাম। রাতের অন্ধকারে আমরাই ছিলাম পাড়ার রক্ষাকর্তা। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ত, সারা পাড়াটা পাহাড়া দিতাম....কোনও অপরিচিত মানুষ কেন, কুকুর-বিড়ালও এলাকায় ঢুকতে পারত না। সেই রাতের আধারেই কেষ্টকে কম অপরাধ করতে দেখেছি? নেহাত চিনতাম বলে কিছু বলতাম না। অথচ এমন স্বার্থপর, কখনও যদি ওর বাড়ি যেতাম, এমনভাবে তাড়াত যেন কোনও রাস্তার কুকুরকে তাড়াচ্ছে। হাজার হোক....হয়ত তোর বাড়ির মেম্বার নই.... তাই বলে এত অপমান?
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার....একদিন ব্যাটা ওই কেষ্টর হাতেই মার খেয়ে মরলাম। কে না কে ওর বাড়ির অতিথির চামড়ার জুতো নিয়ে পালিয়েছে....বাইরে বেরিয়ে এসে আমাকে দেখতে পেয়েছে....বাড়ির সব ক'টা মিলে সেই বাঁশ, লাঠি....আরও কত কিছু নিয়ে সেই কি মার আর কি মার! এমনিতেই খাওয়া দাওয়ার কোনও নিশ্চিত ঠিকানা আর পরিমান ছিল না আমাদের। যা পেতাম, যেটুকু পেতাম তাতেই কাজ চালাতাম। কতটাই বা খেতে পেতাম! ফলে শরীরে খুব একটা শক্তি কোনও দিনই ছিল না। তাই সেই এক সাথে মার আর সহ্য করতে পারিনি (শুনলাম, আজকাল নাকি আপনারা কোনও ভালো কাজ এক সাথে মিলে মিশে না করতে পারলেও খারাপ কাজগুলো ঠিক এক সাথে করতে পারেন! সেই গণধোলাইয়ে এই পটলা পটল তুলল।
তারপর থেকে সেই আত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমাদের তো আর কেউ সৎকার করে না, তাই আত্মার মুক্তি নেই।
কাল রাতে দেখলাম কেষ্ট আর তার পরিবার এসেছে রাস্তার পাশের ধাবায় খাবার খেতে। ওদের দেখে প্রথমটায় খুব রাগ হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, সশরীরে কোনও দিন ওদের কোনও ক্ষতি করতে পারিনি....এবার যদি ভূত হয়ে বদলা নিতে পারতাম। কিন্তু পারলাম না। কিন্তু তারপর যা ঘটল......উফফফ.... ফাটাফাটি। আমার প্রতিশোধ নেওয়া হয়ে গেল।
তাহলে খোলসা করেই বলি....
সবে মাত্র পাশের পাড়ার লালির সাথে একটু প্রেম ভালোবাসা হওয়ার সুযোগ দেখা দিয়েছিল। তাইতো নিজেকেও ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। তাই মরার পরেও নিজের দেহটার প্রতি একটা ভালোবাসা রয়ে গিয়েছিল। খোঁজ রাখতাম...কী হল আমার দেহটার!
আসলে আমি মরার পরে আমার শরীরটাকে তুলে নিয়ে গেল ওই মিউনিসিপ্যালিটির লোকগুলো। নিয়ে ফেলল একটা খোলা জায়গায়। ক'দিন পরে দেখলাম...কিছু লোক এসে অনেকগুলো মরা দেহ, তার মধ্যে আমারটাও ছিল, গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গেল। তারপর সেখানে শালাগুলো আমাদের দেহগুলো কেটে কেটে, কী সব মিশিয়ে, প্যাকেটে করে পাঠিয়ে দিল দোকানে দোকানে। আমার গা টা কেমন যেন ঘিনঘিন করে উঠল! এরা কি মানুষ! পয়সার জন্য লোক ঠকিয়ে মানুষ মারছে? ভাবনা এল....যদি একদিন মাংসের জন্য সব পশুর দেহ শেষ হয়ে যায়, তবে কি এরা মর্গ থেকে........!!!
ভাবতেই কেমন যেন বমি বমি পেল। আর ভাবতে পারলাম না। এর থেকে আমরাই ভালো.....অন্তত ভালো হওয়ার ঢং করি না।
যাই হোক...আমার কাটা টুকরোগুলো এই ধাবাতে এসেছিল...আজ তাই দিয়ে বেশ কষিয়ে মাটন রান্না হয়েছে। মরার পরে জাতে উঠলাম, নাকি নামলাম....এটা নিয়ে ভাবতে পারতাম....ভাবলাম না, কারণ আমরা জাত নিয়ে মাথা ঘামাই না।
শেষ পর্যন্ত এল সেই মুহূর্ত... যখন আমার মাটন কষিয়ে বাটি করে গেল কেষ্ট আর তার পরিবারের পাতে এবং তারপরে পেটে।
হা হা হা হা হা .....নে আরও বল..... রাস্তার কুকুর.....হা হা হা হা
শুধু যদি একটু ব্যাটার স্বপ্নে গিয়ে মাটনের গল্পটা জানিয়ে আসতে
পারতাম.......
তবু আত্মসুখে গলা ছেড়ে ডেকে উঠলাম....
ঘেউ ঘেউউউউ ঘেউউউউউ..........
সমাপ্ত
© FB.com/arindam.gupta.7