সুন্দর একটি গোছানো সংসার ছিল তিয়াসার। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। বাইরে থেকে যে সংসারটা দেখতো, সেই ভাবতো ওরা খুব সুখী। তিয়াসা সুখী ,কিন্তু কোথাও একটা না পাওয়া থেকে গেছিল।
তিয়াসার স্বামী প্রদীপ সবকিছু পারফেক্ট পছন্দ করত। অল্প কোন কিছু পান থেকে চুন খসলেই খুব রাগ করতো,মেজাজী মানুষ ছিল। জমিদারি রক্ত গায়ে। সাধারণ সাদামাটা ছিল তিয়াসা। মাছের ঝালে নুন বেশি হওয়ার থেকে শুরু করে ঘরের ছাদের কোনে ঝুলে থাকা ঝুল, মেয়ের স্কুলের জুতায় কালি লেগে থাকা থেকে রুমাল পরিষ্কারভাবে কাচা প্রত্যেকটি বিষয়ের মধ্যে কিছু না কিছু খুঁত রেখে দিত তিয়াসা। অফিস থেকে ফিরেই প্রদীপ এই খুঁতগুলো ঢাকার কাজে লেগে পড়তো , চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত, নিজের ব্যবহারে বুঝিয়ে দিত যে তিয়াসা কতটা অকর্মণ্য । ভেতরে ভেতরে তিয়াসার মনোবল কমে যেতে থাকে,সবসময় ভাবতে থাকত তার দ্বারা কোন কিছুই হবে না। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দরকার ছিল অনেকটা মানসিক জোর যেটা তিয়াসা তার স্বামীর থেকে প্রত্যাশা করতো ।
ভগবান বিশ্বাসী ছিল তিয়াসা।জানত যে ভগবান একটা না একটা রাস্তা ঠিকই বার করবে।কিন্তু ভগবান যে এভাবে তাকে তার মানসিক জোর ফিরিয়ে দেবে, সেটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। হঠাৎ একটা ঘটনা জীবনটা তছনছ করে দিল, মর্মান্তিক এক গাড়ি এক্সিডেন্টে একটি পা হারায় প্রদীপ। প্রথমদিকে তিয়াসা কিভাবে সবদিক সামলাতে ভেবে পায়না, অথৈ জলে পড়ে যায়। পাশে থাকা মানুষগুলোও ধীরে ধীরে সরতে থাকে। তার জন্য কাউকে দোষ দেয় না তিয়াসা সে জানে সকলেরই সংসার আছে, নিজের কাজ আছে, হসপিটালে আগত লোকের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে। নিজেকেই নিজের অবলম্বন বানাতে হবে বুঝে নেয় তিয়াসা।সে বুঝতে পারে এই লড়াইটা শুধু তার আর প্রদীপের।লড়তে তাকে হবে, নিজের জন্য , প্রদীপের জন্য, নিজেদের মেয়ের জন্য। তিয়াসা নিজেকে শক্ত করে পাথরের মত শক্ত,ছোট্ট মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা নিজের মনোবল গুলো একত্রিত করতে থাকে। তার দিকে তাকিয়ে থাকা দুটি করুন মুখে হাসি ফোটাতে হবে তিয়াসাকে এই ভেবে রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের জলকে বোঝাতে থাকে।বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালে চিকিৎসা চলার পর প্রদীপকে নিয়ে বাড়ি ফেরে তিয়াসা।এতদিন পর বাবাকে পেয়ে ছোট্ট মেয়েটির আনন্দ ফিরে আসে, তবে প্রদীপকে পুনরুজ্জীবিত করতে আরো অনেক কষ্ট তিয়াসাকে করতে হয়।ছোট্ট মেয়ের থেকেও অনেক ছোট হয়ে যায় প্রদীপ। ওকে সামলানো অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে । অদ্ভুত ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় মানুষটার স্বভাব ।যে সবকিছু পারফেক্ট না হলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় কর়তো এখন আর তার গলা দিয়ে কোন শব্দই বের হয় না। একেবারে শান্ত হয়ে যায়।একজন মেজাজী মানুষের মেজাজ চলে গেলে বোধহয় আর কিছুই বাকি থাকে না। প্রদীপ নিজেকে বোঝা মনে করতে শুরু করে।তিয়াসা উপলব্ধি করে তাকেই প্রদীপের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে হবে।ক্ষত শুধু বাইরের নয় অন্তরের।একটা সময় যে প্রত্যাশা সে প্রদীপের থেকে করতো এখন তার সেই প্রত্যাশা ফিরিয়ে দেবার পালা।
প্রদীপকে কিছুতেই হারতে দেবে না সে।তিয়াশা প্রদীপ কে সব সময় বোঝাতে থাকে,মনোবল বাড়াতে থাকে, বলতে থাকে তাদের থেমে গেলে চলবেনা। একটা সংসার চলে দুটো মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর।এই সংসারে কেউ অকর্মণ্য,অপদার্থ হয়না, হতে পারে কোন কাজ একজন অন্যজনের থেকে বেশি ভাল পারে । সবাই সমান হয় না।তিয়াসা প্রদীপকে বলে,\” যেটা তুমি পারো না সেটা আমি করব আর যেটা আমি পারি না সেটা তুমি করবে এভাবেই সংসারের চড়াই উতরাই পার হবো আমরা, মনের জোরে একটা পা নিয়ে লোকে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে, সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে যাচ্ছে,সেখানে আমরা দুজনে মিলে তিনটে পা নিয়ে একটা সংসার চালাতে পারবো না!" প্রদীপ বুঝতে পারে,প্রতিবন্ধকতা শুধুমাত্র শারীরিক নয় মানসিক হয় ,দুজন আলাদা নয় একসাথে একটা সত্ত্বা হিসেবে কাজ করলে সংসারের কঠিন রাস্তা সহজ হয়ে যায় ,যেটা সে অতিতে কোনদিন করেনি সব সময় নিজেকে মানসিক ও শারীরিক দিক দিয়ে তিয়াসার থেকে উন্নত বলে মনে করেছে কিন্তু নিয়তির পরিহাসে আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত।সংসার সুখের হয় যখন দুটি মানুষ একে অপরের খুঁতগুলো নিজ গুনে ঢাকতে চেষ্টা করে। সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। তিয়াসার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে, নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করে।
নিজেকে গুছিয়ে নিতে প্রদীপের অনেকটা সময় লাগে। কিন্তু সে পারে, তিয়াসার মনের জোর তাকে থামতে দেয় না। কৃত্রিম পা এর ব্যবহার করে শরীর ও মন থেকে প্রতিবন্ধকতা কে দূর করতে। ক্রমশ সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে থাকে তারা। সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে সরিয়ে আজ তারা প্রকৃত অর্থে সুখী ।
সমাপ্ত
© FB.com/ankhi.mukherjee.3