সাইনা বাসে উঠে পড়ে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে । আজ কলেজের সব ক্লাস করতে গিয়ে অনেক দেরি হয়ে গেছে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে । পাঁচটা দশ। ইস ! বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাবে । সবে ডিসেম্বর মাস । শীত জাঁকিয়ে পড়ছে । সোয়েটার এনেছে । শালটা গায়ে জড়িয়ে নেয় । জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে । জানালার কাঁচটা টেনে নামিয়ে দেয় । লোকজন আছে তবে অন্যদিনের চেয়ে একটু কম ।সব মিলিয়ে মহিলা মাত্র তিনজন । দু'জন প্রৌঢ়া পেছনের সিটে বসে আছেন ।একটু কেমন যেন ভয় লাগলো সাইনার ! চারদিকে একবার বাসের ভেতরটা তাকিয়ে দেখে । নাহ! কুড়ি -একুশজনের বেশি যাত্রী হবে না । সব পুরুষ । সবাইকে দেখে তো ভদ্র ঘরেরই লাগছে ।তবে কে জানে ! উপর থেকে দেখে তো ভদ্রই মনে হয় । যতক্ষণ পর্যন্ত না মনুষত্বের মৃত্যু হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত মুখে ভদ্রতার মুখোশটা লেগে থাকে । তবে সকলেই তো মানুষ ! কখন যে এই মানুষগুলো মান আর হুঁশ হারিয়ে ফেলবে তার তো কোনো ঠিক -ঠিকানা নেই । আজকাল খবরের কাগজে , টিভিতে রোজ যা শুনছে আর দেখছে তাতে বাড়ি থেকে বের হতেই ভয় হয় । দুধের শিশুও রেহাই পায় না । কিন্তু বাড়িতে বসে থাকলে কি আর চলবে । আমাদের দেশ তো স্বাধীন হয়েছে । কিন্তু আমরা কি স্বাধীন হয়েছি ? কোথায় সে স্বাধীনতা ? নিরাপদে আজও?
আমরা পথে- ঘাটে হাঁটতে ভয় পাই । সত্যি ! এ কেমন যুগ ! চারদিকের কি বিশ্রী অবস্থা! অথচ আগে কি এমন ছিল । নাকি আগেই এই সব ঘটনা ঘটতো কিন্তু তখন মিডিয়া এতটা সক্রিয় ছিল না । তাই এসব ঘটনা এতটা জানাজানি হতো না । ধামাচাপা দেওয়া থাকতো ।শুধু সময়টা বদলে গেছে । পরিস্থিতি কিন্তু বদলায় নি ।আগে এসব হতো ।আর এখনোও এসব হচ্ছে । বাসটা খুব জোরে ব্রেক কষে ।সাইনা আর একটুর জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল । প্রৌঢ়া মহিলা দুটো নেমে যায় । এবার সাইনার সত্যি খুব ভয় হতে লাগলো । বাড়িতে একটা ফোন করে দাদাকে জানায় । সে বাসে আসছে । আরেকবার এমনি সন্ধ্যে হয়েছিল । তখন রত্না আর পারভীন সাথে ছিল । আজ ওরা কেউ আসেনি । ওরা তিনজনেই ইংরেজি অনার্স নিয়ে খড়্গপুর কলেজে ভর্তি হয়েছে । ওরা তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী । কনডাক্টারকে ভাড়া দেয় । ছটা বেজে গেছে । পলাশপুরে পৌঁছাতে সাড়ে ছটা বাজবে । দাদা বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকবে । সাইনার লেখাপড়া করার খুব ইচ্ছে আছে । মাস্টার ডিগ্রী করতে চায় ইংরেজিতে । সে বরাবর লেখাপড়ায় ভালো । সাইনার জন্য দু-একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে । সাইনাকে ওদের খুব পছন্দ হয়েছে । সাইনার হবু বর শিক্ষক । তবে সাইনা এ বিয়েতে এই শর্তে রাজি হয়েছে যে সে বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যাবে । এতে শশুরবাড়ির সকলে সম্মতি জানিয়েছে । তাই সাইনা খুব খুশি । সাইনা বর্তমান আর ভবিষ্যতের নানা বিষয় নিয়ে এলোমেলো চিন্তা করছিল । বাসটা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়িয়ে যায় । পলাশপুর , পলাশপুর এসে গেছে । সাইনা চমকে ওঠে । চিন্তার রেশ কেটে যায় । তাড়াতাড়ি বাসে থেকে নেমে পড়ে । বাপরে ,বাপ ! হাফ ছেড়ে বাঁচে । দাদার বকুনি ওর জন্য অপেক্ষা করেই ছিল । দাদা রেগে বলে ,আগে বলতে পারিস নি ,আমি তোকে গিয়ে নিয়ে আসতাম । খুব বীরাঙ্গনা হয়েছো , একা একা এই সন্ধ্যেবেলায় কেউ বাড়ি ফেরে ! চলো , বাড়িতে তোমার জন্য সকলে অপেক্ষা করে আছে । সাইনা আমতা আমতা করে বলে ,দাদা ,আমি বুঝতে পারিনি। দাদা কপট রেগে বলেন ,চল ,ঢের হয়েছে আর তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে না । ওগুলো বাড়িতে দিও । সাইনা জানে ,তাকে বাড়িতে সকলে খুব ভালোবাসে । বাবার তো সে স্নেহের পাত্রী । দাদারা এজন্য তার সাথে হিংসে করে । সাইনা এটা উপভোগ করে । হাসিমুখে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায় ।
সমাপ্ত
© FB.com/nurjahan.khatun.92167