দূর্গা পূজার নবমীর দিন ইচ্ছে করে আদিত্য এসেছে নিজের চেম্বারে।আসলে অন্যান্য দিনের থেকে কম ভিড় হয় আর একটু ফাঁকা সময়ে নিজের মতো থাকা ও যায়। আজকে সকাল থেকে বেশ ফাঁকা আছে অন্য দিনের তুলনায়, সবে একজন এসেছেন। সেও চলে যাওয়াতে এখন বসে আছেন ডক্টর আদিত্য মুখার্জী(শহরের একজন খ্যাতনামা মানসিক বিশেষজ্ঞ)।
-আসবো ডক্টর? (একজন মধ্য তিরিশ বয়সি ভদ্রলোক)
-হ্যাঁ অবশ্যই।
- ভেতরে এসে বললেন," আমি শুভ্র রায়। আসলে আমার স্ত্রী এর সম্বন্ধে একটু কথাবার্তা বলতাম.."
-হ্যাঁ অবশ্যই বলুন আমি কি সাহায্য করতে পারি?"
-"আমার স্ত্রীর নাম উর্মি, উর্মি রায়।আমাদের বিয়ে হয়েছে সাত বছর।আমি একজন ব্যাংকের সাধারণ কর্মচারী, তাও নিজের যথাস্বার্থ চেষ্টা করি উর্মিকে খুশি করার। আমাদের বিয়েটা হয়েছিল দেখে শুনে। প্রথম প্রথম উর্মির সেরকম কোন সখ ছিল না অতি সামান্য জিনিসেই খুশি থাকত কিন্তু বর্তমানে আর কিছুতেই খুশি নয়। আমাদের ছেলে হওয়ার পর ওর চাহিদা প্রচুর বেড়ে গেছে, আমি যতই বোঝানোর চেষ্টা করি কিছুতেই বোঝে না বরং অন্য সকলের সাথে তুলনা করে। আমার নিজেকে বড়ই বেমানান মনে হয় ওর সামনে।অশান্তি টা আরও বেড়েছে ইদানীং, আমি কিছুদিন আগে ওর ডাইরি পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম ওকে ১০ বছর আগে প্রপোজ করেছিল একটি ছেলে। ছেলেটিকে নিয়ে ওর ডাইরির পাতাতে অনেক বর্ননা আছে। স্বাভাবিক আমি জানতে চাইলে উল্টে অশান্তি করে আমি ভাবিনি ওরকম কিছু হবে। সেই ডাইরিটাকে ওর অনুমতি না নিয়ে পড়ার জন্য নানা কথা বলা হল, সে নয় আমার ভুল মানলাম কিন্তু তা বলে আমায় যে এতো বছরে কিছু বলে নি সেটা? তাও ঠিক ছিল সেই ছেলে নাকি এখন অনেক বড়ো ডাক্তার, উর্মি এখন কথায় কথায় খোঁটা শোনায় আমাকে যে, আমাকে বিয়ে না করে তাকে বিয়ে করলে সে অনেক বেশি খুশি থাকতো। আমি সত্যি আর পারছি না, মানছি আমি ওর কোন যোগ্য নই কিন্তু বড্ড ভালোবাসি আমি ওকে।" -(এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো শুভ্র।)
-আসলে কি বলুন তো এরকম ক্ষেত্রে হয় কি আপনি আপনার দিক দিয়ে বলেন আর আমরা সেটা বুঝে এগোই এর চেয়ে ভালো আপনি একটা কাজ করুন কালকে আপনার স্ত্রীকে সাথে করে নিয়ে আসুন।আগে দুজনের বক্তব্য শুনবো তারপর বলি কি করা যায়। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাদের বিয়ের সাত বছর হয়েছে বললেন এর মধ্যে আপনার সামনে কি তিনি একবারও সেই ছেলেটি সম্পর্কে একটা কথাও বলেনি??
-না, ও খুব চাপা স্বভাবের কিছুতেই মনের কথা স্বীকার করে না।
-ওহ, তাহলে আপনি ভুল করেছেন এতে আপনিও সমান দোষী , কিন্তু সে যাই হোক আপনার স্ত্রীর সাথে কথা না বলে কিছুই বলা যাচ্ছে না, আপনি এক কাজ করুন আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আসুন।আমি ওনার সাথে কথা বলে তারপর বলবো।
-ঠিকাছে, আজকে তাহলে উঠি পরে নিশ্চয়ই আসবো। আপনার ফিজ টা?
-না থাক পরের বার দেবেন এখন তো কিছুই করা হয়নি।
-ওকে, নমস্কার আসছি।বেড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আদিত্য মনে মনে বলল "উর্মি নাম টা তো আমারও কোন এক সময় প্রিয় ছিল নামটা কেন নামের অধিকারীনিটিও। " গল্পের মতো মনে পড়ে গেল তার দশ বছর আগের কথা-----------------------------------তখন সে দ্বাদশ শ্রেনীর ছাত্র। যথেষ্ট ভালো পড়াশোনা তে তাই সারাদিন বই এর সাথেই বন্ধুত্ব ছিল। অন্য বন্ধু থাকলেও তারা কেউ পাত্তা দিত না দেবেই বা কেন কারো সাথে কথাই বলতো না সে। একদিন অংকের ব্যাচে একটা নতুন মেয়েকে দেখে ভালোলাগা, ব্যাচে সব চেয়ে শেষে ভর্তি হবার জন্য আদির কাছ থেকে খাতা চাইতে এসে প্রথম কথাবার্তা হয়। আদি যেরকম শান্ত ঠিক তার উল্টো এই উর্মি। উর্মি কে প্রথম থেকেই ভালো লাগলেও মুখে বলেনি আদি। ওদের বন্ধুত্ব টা বেশ এগোচ্ছিল। এবার দুর্গা পুজোতে একসাথে আশেপাশে ঘুরবে বলে ওরা প্ল্যান করেছিল,কিন্তু বৃষ্টি তে তা না হলে ওরা বুদ্ধি করে এক সাথে যাবে অষ্টমীর অঞ্জলি দিতে। আদি একটি লাল পাঞ্জাবি পরেছিল আর উর্মি পরেছিল একটি হলুদ শাড়ি। উর্মি ওই হলুদ শাড়িটাতে হলুদ পাখির মতো লাগছিল আদির কাছে।আসলে তখন হলুদ পাখি গানটা খুব জনপ্রিয় ছিল। আর সে জন্যই হয়তো সে উর্মিকে দেখে নিজের বেসুরে গলায় গেয়েছিল৷
"সেই যে হলুদ পাখি
বসে জামরুল গাছের ডালে
করতো ডাকাডাকি
আমার শৈশবের সকালে৷
একদিন গেল উড়ে৷
জানি না কোন সুদুরে
ফিরবে না. সেকি ফিরবে না.
ফিরবে না আর কোনওদিন.
ফিরবে না. সেকি ফিরবে না.
ফিরবে না আর কোনদিন."
-দূর তুই না কতো কষ্ট করে পরেছি শাড়িটা আর তুই... তোর বউ কাক হবে কাক।আমায় হলুদ পাখি বললিতো তখন দেখিস কেমন লাগে।"-বললো উর্মি ।তারপর বললো দেখ একবার অঞ্জলি হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি চল মণ্ডপের দিকে নইলে হবে না।অঞ্জলি দেওয়ার পর ওরা দুজনে পাশের ক্লাবে ঘুরলো আর সাথে ফুচকা, আইসক্রিম, আর ও কত কিছু খেল।সারাদিন ধরে একসাথে ঘুরে ফিরে যখন আবার ক্লাবে এলো তখন সুর্যাস্তের সময়। শরতের সাদা মেঘের মধ্যে সূর্যের লাল আলোর সমন্বয়ে আকাশের রঙ লাল।
- দেখ কি সুন্দর আকাশ (উর্মি বলল)
-ওইসব না ভেবে বাড়ি চল এরপর বকা খাবি নইলে বাড়িতে। আর একটা কথা বলি তোকে?
- হ্যাঁ বল।
-আমি তোকে মনে হয় ভালোবেসে ফেলেছি, তোকে প্রথম যেদিন দেখলাম সেদিন থেকেই! কিন্তু আমার কোন বন্ধু না হওয়ার জন্য তোকে এইকথা গুলো বলে হারাতে চাইনি..! আর তুই যদি নাও বলিস অন্তত বন্ধুত্ব টা রাখ... (এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো আদি)।
(উর্মির সাদা মুখটি তখন রাঙা বর্ন ধারণ করেছে সেটা রাগে না লজ্জায় সেটা বোঝা যাচ্ছে না)উর্মি এবার কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল মন্ডপ থেকে শুধু যাওয়ার আগে বলে গেল "এটা আমি তোর কাছ থেকে আশা করিনি"।
-তারপর একই ব্যাচে পরলেও কথা কেউ বলতো না। কিছুদিন পর যখন আদি ডাক্তারি পড়তে বাইরে যাবে তার আগে এক বন্ধু কে দিয়ে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল কিন্তু উর্মি সেখানে রাজি হয়নি।।।।
হঠাৎ রমাদা এসে ডাক দেওয়ার জন্য আদির সেই ভাবনাতে ব্যঘাত ঘটলো।
-ডাক্তারবাবু আর কেউ কেউ নেই আর হয় তো আসবেও না কেউ।
-হ্যা চলো।
*******************************************
এক সপ্তাহ পরে
-ডাক্তার মুখার্জী আসবো?
-হ্যাঁ মিস্টার রায় আসুন। মিসেস রায় আসেন নি?
-হ্যাঁ, উর্মি ভেতরে আসো।(ভেতরে এসে দুজনেই চেয়ারে বসলো)
-নমস্কার আমি আদিত্য মুখার্জী।
-নমস্কার আমি মিসেস উর্মি রায়
- ডাক্তার মুখার্জী আপনারা কথা বলুন আমি আসি। (শুভ্র)
-আপনি এখানে বসতেও পারেন অসুবিধা নেই।
-নানা আমার একটা কাজ আছে আমি এই ১৫ মিনিট পরে আসবো।
-ওকে আপনার ইচ্ছে।
(শুভ্র বেরিয়ে যাবার পর)
- কেমন আছেন মিসেস রায়?
- তোর সেদিন কি আমাকে কথা গুলো বলা খুবই দরকার ছিল?আর তারপর চলে যাবার পর আর কোন যোগাযোগ ও নেই? তুই ই তো বলেছিলি অন্তত বন্ধুত্বটা রাখবি তা বলে আর যোগাযোগই রাখলি না (কথা গুলো এক নিঃশেষ এ বলে থামলো)
-মিসেস মুখার্জী সে কথা বলে কোন কিছু হবে?এখন বলুন কেমন আছেন আপনি?
-আপনি?? এতো অচেনা হয়ে গেলাম?
-হ্যাঁ, আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।আমি সেই উর্মি কে চিনি যার মুখ দিয়ে কথার ফুলঝুরি ফুটতো ,ছোটছোট জিনিস এ যে আনন্দ খুঁজে পেত, যার হাঁসি তে বাস করতো স্নিগ্ধতা, এই মিসেস উর্মি রায় নয় যে নিজের স্বামীর সাথে অন্য সকলের তুলনা করছে, যে নিজের এতো ভালো স্বামীর সাথে দশ বছর আগের কোন এক বন্ধুর তুলনা করছে....।
-হ্যাঁ, সেই আমারই দোষ আসলে দোষ টা কিসের বল তো নিজের স্বাধীনতা কে বিসর্জন দেওয়া, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অচেনা লোকের সাথে এতো বছর সংসার করা। জানিস সেই আগের উর্মি সেই দিনেই মরে গেছিল যখন আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে ঠিক হয়, অন্তত মাস্টার্স করার ইচ্ছে টাও শেষ...বিয়ের আগে এই শুভ্র বলেছিল পড়াবে আর থাক সে কথা! আর আমার স্বপ্ন তুই জানতিস সেই লেখালেখি । ওগুলো এখন দুঃস্বপ্ন...তাও দোষ আমার..। ছেলের স্কুলে অন্যান্য সব মায়েরা যখন নিজের শখ নিয়ে ব্যস্ত আমি তখন নিজের স্বামীর প্রশংসা করতে, শুধু এই নাকি আমার প্রতি কাজে সন্দেহ এভাবে বাঁচা চায়.. ওহ মেয়েরা তো এটাই করবে শুধু অ্যাডজাস্ট। আর কতো? আর কি করলে বল তো সেই ফেরত পাবো নিজেকে সেই উর্মি কে? আর কি যেন বললি ভালোবাসা থাক সে কথা? আমায় ভালোবাসে না আমার শরীর এর প্রতি ওর ভালোবাসা, যে সম্পর্কে বিশ্বাস নেই সেটাকে ভালোবাসা বলে না, সব দায়িত্ব আমার, সব কর্তব্য আমার ,আর তিনি চাকরি করে তার কর্তব্য হুকুম করা আর আমার পালন করা...। এরপরও বলবি এই উর্মি কেন হয়েছি???(দুজনেই চুপ)
-আসবো ডাক্তার মুখার্জী?
- হ্যা, অবশ্যই। আপনারা দুজনেই একসাথে বসুন, একটা কথা বলি মিস্টার রায় আপনি যে বললেন আপনার স্ত্রী কারো নামে কবিতা লিখেছিলেন সেই ব্যক্তিটির বাস্তবিক অস্তিত্ব নেই। মিসেস রায় কে আমি চিনতাম। আগে আমার সাথে এক সাথে পড়তো কিন্তু আপনি যেরকম বর্ননা করলেন আমি কিন্তু সেরকম উর্মি কে চিনি না। আমাদের ব্যাচের সব চেয়ে বকবক করা মেয়ে ছিল উর্মি, আর আপনার বর্নিত উর্মিকে আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারবো না...।আপনাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সাত বছরের আর আপনি এখনও চেনেনই না, আপনি কি জানেন আপনার স্ত্রী মিসেস উর্মি রায় খুব ভালো কবিতা লিখতেন, আপনি ভেবেছিলেন উনি ওনার প্রেমিক কে নিয়ে লিখেছেন আসলে ও ওরকমই উর্মি প্রচুর কল্পনা প্রবল। আর একটি কথা - সম্পর্কে বিশ্বাস ছাড়া কোন সম্পর্কই টেকে না তাহলে আপনাদের দুজনেরই কর্তব্য একে অপরকে বিশ্বাস করা। আর মিসেস রায় শুভ্র আপনার স্বামী। কোন টাকার মেশিন নয় একটু আডজাস্ট তো আপনাকেও করতে হবে।।। আর হ্যাঁ কোন ফিস দেবেন না কারণ আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি । আপনার জন্য আবার আমি আমার খুব প্রিয় একজন বান্ধবির খোঁজ পেলাম। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আর একটা কথা পারলে উর্মিকে আবার মাস্টার্স এ ভরতি করান...।
- উর্মি তুমি তো ওনার সম্পর্কে আগে বলোনি? (শুভ্র বলল) উর্মি কিছু বলার আগেই শুভ্র বলল "আসলে আমি সেই ব্যক্তি যিনি আপনার স্ত্রী কে প্রপোজ করার সাহস দেখিয়েছিলাম, আর সত্যি কারে দেখুন আমায় যদি না না বলতো ও তাহলে আমি আর আপনার সামনে বসে থাকতাম না,আর উর্মি ক্ষমা করিস রে আমার ভুল ছিল ওটা আর মিস্টার রায় আমি কিন্তু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে ফেরত চাই আপনার এই মিসেস উর্মিকে না। আপনারা সময় দিন একে অপরকে সব ঠিক হয়ে যাবে....।"
-এবার শুভ্র হেসে বলল" অবশ্যই আমি ও এই পুরানো ভার্সনটাকে নিয়ে প্রচুর হাঁপিয়ে গেছি একটু আপডেট হলে ক্ষতি নেই....। "
সমাপ্ত
© FB.com/suchita.banerjee.79