অনেক বেলা হয়ে গেছে! পুকুর পাড়ে শুশনি শাক, কুলে খাড়া শাখা তুলতে এসেছে সেই কোন ভোরবেলায়। এক টুকরো কাগজে একটু তামাক চুপিচুপি সনকার কৌটো থেকে সরিয়ে আঁচলে বেঁধে রেখেছিল। তা ন'টা বাজবে বোধহয়। বেলা ঢের হয়েছে। মুখ এখনো ধোয় নি। এক ঝুড়ি শাক তুলেছে। এবার সোজা বাজারে গিয়ে বসবে। বিক্রি করে দুপুর বেলা বাড়ি ফিরবে। আঁচল খুলে তামাক বের করে দাঁত মেজে নেয়। তারপর তিন টাকা দিয়ে এক কাপ চা ও ঘর থেকে আনা একটু মুড়ি খেতে খেতে একটু জিরিয়ে নেয়। পুকুর পাড়ে বসে কত অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। ভোরবেলায় প্রতিদিন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সেই দুপুর গড়িয়ে ঘরে ঢোকে। কোনোদিন সন্ধ্যে হয়ে যায়। ঘরে যেতে ইচ্ছে করে না। বাজারে চুপচাপ বসে থাকে। সব শাক বিক্রি হয়ে যায় তবু বসে থাকে। তার তো ঘর বলতে নিজের নেই! স্বামীও তো পরের হাতে সঁপে দিয়েছে! নিজের সংসার ভাগ করেছে সতীনের সাথে। কোনো স্ত্রী নিজের সংসার অন্য নারীর সাথে ভাগ করতে চায়! বিনতাও চায় নি। বাধ্য হয়েছিল! বিয়ের দশবছর পরেও মা হতে পারে নি। শেষ পর্যন্ত শাশুড়ির চাপে, স্বামীর মুখ চেয়ে স্বামী, সংসার সব ভাগ করে সনকার সাথে। সেদিন রাতে বিনতা খুব কেঁদে ছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সনকা ফুটফুটে ছেলের জন্ম দিল। তারপর এক মেয়ে। শাশুড়ি মারা গেল। সনকা একধারে পুরোনো ,অকেজো আসবাবের মতো পড়ে থাকলো। সবার খাওয়া শেষে একটু শুকনো ভাত, তরকারি পড়ে থাকে তার জন্য। সেটুকু খেয়ে এঁটো থালা-বাসন নিয়ে মাজতে যায়। উনুন জ্বালানো, জল আনা, সংসারের যাবতীয় ভারি কাজগুলো বিনতা করে। স্বামী হারাধন, সনকা আসার পর থেকে কোনোদিনও বিনতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নি। সনকাকে সে চোখে হারায়। বিনতা ভাবে, হারাবেই তো! সে তো সন্তানসুখ দিতে পারেনি স্বামীকে। ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখাশোনা করে, খাওয়ানো, সব দায়িত্ব বিনতার। সনকা তো সব সময় সেজেগুজে একেবারে পটের বিবি হয়ে থাকে। বিনতার আর পরের সংসারে ভালো লাগে না। ভেতরের ঘর থেকে তার জায়গা হয়েছে বাইরের ঘরে। প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগতো। কত রাত শুধু চোখের জল ফেলেছে! দু' চোখ এক করতে পারে নি। তারপর ধীরে ধীরে অভ্যেস হয়ে গেছে! পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। রাতে ঘুমানোটুকু ছাড়া এ বাড়ির আর তার দরকার নেই। তার প্রয়োজন তো সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল যেদিন সনকা তার সংসারে এসেছিল। কোনোদিন দেরি করে বাড়ি ফিরলেও কেউ কোনো কিছু জানতে চায় না। তবু বিনতার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই! কোথায় যাবে! ওই আশ্রয়টুকু আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকে। স্বামী, সন্তান সুখ তো জুটলো না, যদি শেষমেষ স্বামীর হাতের আগুন পায়, স্বামীকে রেখে এ পৃথিবী থেকে যেতে পারে! এ কি কম সৌভাগ্যের! অভাগিনীর এ আশাটুকু হয়তো পূর্ণ হবে! বুকে এই সুপ্ত আশা নিয়ে কোনোরকমে দিন কাটায়।
সমাপ্ত
© FB.com/nurjahan.khatun.92167