Mrs. Understanding - A bengali story

Jolchobi

মিসেস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং

মুক্তিপ্রকাশ রায়

বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে গোটা দিনটা প্রাণীবিশেষের রন্ধ্রবিশেষে ঢুকে যায়। ভিড় লোকাল ট্রেনে তিনজনের সিটে ঝোঝুল‍্যমান চতুর্থ ব‍্যক্তির মতো অস্বস্তিতে কাটে সারাক্ষণ। কোনও কাজ তখন আমার ঠিকঠাক হয় না।
তাও ছোটোখাটো ব‍্যাপার থেকেই মাঝেমাঝে আগুন জ্বলে ওঠা ঠেকানো যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল বোঝাবুঝির ফুলকি থেকে দাবানল। তবু যে কেন ভুল বোঝাবুঝির ইংরেজি 'মিস-আন্ডারস্ট‍্যান্ডিং' কে জানে! 'মিসেস-আন্ডারস্ট‍্যান্ডিং' হলে বেশি লাগসই হত না কি?
শুক্কুরবার সকালে কী থেকে কী হয়ে গেল কে জানে! এককাপ চা চাইতে গেছি, বউ গর্জনশীল আটত্রিশার মতো ('চল্লিশা' হতে বছরদুই দেরি আছে) গাঁকগাঁক করে উঠল-- তোমার লজ্জা হয় না আমার কাছে এসে ফের ন‍্যাকামি করতে? আমার চরিত্র তুলে কথা বলেছ তুমি। এত আস্পদ্দা তোমার হয় কী করে?
আমি তো মশাই পুরো বোমকে গেলুম। আমি চিরকালই ভিতু মানুষ। বউয়ের চরিত্র তুলে কথা বলব -- এতবড়ো ওথেলো আমি নই। মিনমিন করে সাফাই গাইতে গিয়ে আরও পাকিয়ে ফেললুম ক‍্যাঁচালটা। সবে বলেছি -- আমি কখন এসব বলতে গেলুম রে বাবা! তোমার হয়তো বুঝতে ভুল হয়েছে-- অমনি ধিকিধিকি আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।
-বুঝতে তো আমার ভুল হবেই। আমি তো অশিক্ষিত, তাই না? যত শিক্ষা তো তোমাদের ফ‍্যামিলির। সাধুভাষায় গালাগাল দিলে আমি বুঝতে পারব না ভেবেছিলে, কেমন?

গোটা ব‍্যাপারটাই চরম দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিল আমার। চাইনিজ দুঃস্বপ্ন। যার বিন্দুবিসর্গ আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। কলেজের কোনও কাজে মন বসাতে পারছিলুম না। ফচকে অধ‍্যাপক মানব এসে দুচারটে আদিরসাত্মক জোক শুনিয়ে, আমাকে একটুও হাসাতে না পেরে, নিজেই ফ্রাস্টু খেয়ে ফিরে গেল। সদাকৌতূহলী বিনয়দা জিজ্ঞেস করলেন, অশৌচ-টশৌচ চলছে না কি? দাড়ি কামাওনি!
দুপুরের পর ঘটনা আরও বীভৎস আকার ধারণ করল। বউকে এইজন্য আমি খুবই শ্রদ্ধাভক্তি করি। একটা ঘটনা ঘটবার উপায় নেই, সঙ্গে সঙ্গে সেটা "গান্ধার হতে জলধি-শেষ" ছড়িয়ে পড়বে। এই ট‍্যালেন্ট সে গ্রামের ইস্কুলে ইতিহাস পড়িয়ে নষ্ট করছে। চাইলে যেকোনও নিউজ চ্যানেল তাকে লুফে নিত। এবিপি আনন্দে অনুষ্ঠান টেলিকাস্ট হত -- 'ঘন্টাখানেক সঙ্গে সুমনা'।

প্রথম ফোন এল ভবানীপুর থেকে। শাশুড়ির।
-অ‍্যাই, তুমি সুমিকে কীসব উলটোপালটা বলেছ?
-আ আ আ
-আবার 'আ আ' করা হচ্ছে! অসভ্য ছেলে কোথাকার! এইজন্যই সুমিকে গ্রামের ছেলে বিয়ে করতে বারণ করেছিলাম।
-আরে আপনি তো আমাকে বলতেই দিচ্ছেন না! আমি কিছুই বলিনি আপনার মেয়েকে।
-মানে? তুমি ওর চরিত্র তুলে কথা বলনি? তুমি কি বলতে চাও --আমাদের মেয়ে মিথ‍্যেবাদী?
এই সেরেছে! আমি মনে মনে আতঙ্কিত হলুম। এই কথাটা বউয়ের কানে উঠলে আর দেখতে হবে না।
-কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে থাকবে। আপনি টেনশন নেবেন না।
-তুমি আমার মেয়ের সম্পর্কে যা তা বলবে না একদম। এসব তোমাদের গেঁয়ো কালচার। পুকুরপাড়ে জল আনতে গিয়ে মেয়েরা এসব নোংরা কূটকচালি করে।
-দেখুন, আপনি ভুল বুঝছেন।
-কী ভুল বুঝছি?
-আমাদের বাড়ি গেঁয়ো নয়। আমাদের অ‍্যাকোয়াগার্ড আছে।

এই বলে ফোনটা কেটে দিতে তখনকার মতো রক্ষা। কিন্তু দ্বিতীয় ফোন এল হায়দ্রাবাদ থেকে। বউয়ের রেঞ্জ দেখেছেন? এটি আবার আদুরে শ‍্যালিকার ফোন।

-জ‍্যাজ, তুমি দিদিভাইয়ের নামে কী বলেছ?

আমি শ‍্যালিকার ওপর কখনওই খুব একটা রাগ করতে পারি না। 'জ‍্যাজ' ডাকটা ওর নিজের বানানো। 'জামাইবাবু', 'জিজু' এসব নাকি ক্লিশে হয়ে গেছে। আদুরে গলায় 'জ‍্যাজ' সম্বোধন শুনলেই মনে একটা ঝুমঝুম করে গান বেজে ওঠে। কিন্তু আজ মেজাজটা ঠান্ডা রাখা মুশকিল হচ্ছিল।

-কিছু বলিনি রে বাপ! তোর দিদিভাই সতী সুলোচনা। তবে মাথায় গোবর থাকা অসম্ভব নয়। কী বুঝতে কী বুঝেছে ভগাই জানে।
-বিয়ের আগে দু-একটা অ‍্যাফেয়ার তো সবারই থাকে। তুমি নিজেই তো সঙ্গীতা না রঙ্গীতা বলে একটা মেয়ের পিছনে ল‍্যাংল‍্যাং করে ঘুরতে।

শ‍্যালিকা কিছু-না-হোক একই কারখানার প্রোডাক্ট। যেমন বেলাইনে তক্কো, তেমন ভাষা। শেষ চেষ্টা করা গেল।
- ওরে ওসব আমাকে বোঝাতে হবে না। আমি তো আর তালিবান বা আরএসএস না! অত গোঁড়ামি আমার নেই।
-তাহলে তুমি দিদিভাইকে 'কুলটা', 'স্বৈরিণী' এসব বলেছ কেন?
কুলটা? স্বৈরিণী? আমার মাথা কেমন করে উঠল। ফোনটা কেটে দিয়ে গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলুম এই অপপ্রচারের কারণ কী হতে পারে। ফ্ল্যাশব‍্যাকে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো একবার নেড়েচেড়ে না দেখলেই নয়। দেখতে দেখতে আমার সত‍্যদর্শন হল।

ঘটনার সূত্রপাত দুই সন্তানের অঙ্কাতঙ্ক দূর করার পরিকল্পনা থেকে। বউ এ-বিষয়ে আমার ওপর ভরসা করতে চায় না। যারা সাহিত্য নিয়ে পড়ে, তারা অঙ্কে কাঁচা হবে এমন কোনও কথা নেই। ইন ফ‍্যাক্ট, উঃ মাঃ পরীক্ষা অবধি আমি কাতরোক্তি না করেই উতরে গেছি। 'অঙ্কোলজিস্ট' কথাটা শুনলে আমি যে ঘাবড়াই, তার জন্য আমার অঙ্ক নিয়ে কোনও অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা দায়ী নয়।
তবে আমার অঙ্কশায়িনী হয়তো ভাবে, সাহিত‍্য আমার মাথামাটিক্সের মাথাটি মাটি করেছে (শিব্রাম স্মর্তব্য), কিংবা আমি টেনসজ্ঞানবর্জিত ছাত্রছাত্রীকে মেটাফিজিক্স বোঝানোর দুরূহ কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকায় অপত‍্যদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার সময় পাব না।
তাই আমাদের পুত্রযুগলকে একটি প্রতিষ্ঠানের ছত্রছায়ায় রেখে সে আপাতত নিশ্চিন্দি হতে চায়। ভয়ানক প্রতিষ্ঠান। ক-দিন তার চৌহদ্দি মাড়ালেই ছানাপোনা নাকি অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। তিনহাজার পাঁচশো বিরানব্বইকে পাঁচহাজার তিনশো উনতিরিশ দিয়ে গুণ করলে কত হয় -- তা ক‍্যালকুলেটরের আগে বলে দিতে পারে। ডানহাতে, বাঁহাতে, বোধহয় পায়ের সাহায্যেও, লিখতে শিখে যায়। পুরো পয়সা উশুল প‍্যাকেজ আর কী।
আমার অবিশ‍্যি একটা গোপন অ‍্যাজেন্ডাও ছিল। যেহেতু আমি কেবল একহাতেই লিখতে পারি, তাই হয়তো লেখক হিসেবে আমার তেমন নামডাক হয়নি। ছেলেদুটো যদি দুহাতে-দুপায়ে লিখে কিছু করেকম্মে খেতে পারে, মন্দ কী? ডান-বাম কোনও দলেরই সেক্ষেত্রে অপছন্দ করার কিছু থাকবে না।
তা বউ নিজেই সব যোগাযোগ করে ফেলেছিল। আমার কাজ ছিল কেবল ফর্মে সই করা। পতির সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার খুব একটা তফাত নেই।
মুখ বুজে সই করে দিলেই হত। কিন্তু ওই যে কথায় আছে --- "বাঁশ কেন ঝাড়ে" ইত‍্যাদি ইত‍্যাদি। সই করতে করতে বলেছিলুম, সব দিক থেকে স্বনির্ভর তুমি, তবু আমার কাছে সই-ঋণী রয়ে গেলে।

তখনই লক্ষ করা উচিত ছিল -- বউয়ের মুখে কিউম‍্যুলোনিম্বাস ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু আমি তখন সর্বনাশের পথে চলেছি। "কার সাধ‍্য রোধে মোর গতি"।
ফর্মটা নেড়েচেড়ে বললুম, রোববার দুপুরে ক্লাস? কে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে ওদের

মনে একটু ভয় থেকেই কথাটা বলা। রোববারের ভাতঘুমটি গচ্চা যাওয়ার ভয়।

অভিমান-কম্পিত গলায় বউ বলল, কে আবার? আমিই নিয়ে যাব। ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো তো আমিই আছি।

অভিমান ভঞ্জন করতে মধুমাখা কণ্ঠে তখন বলেছিলুম আমি, ভাঙা হোক, গোটা হোক, তুমিই তো আমার একমাত্র কুলো-টা।

বাকিটা বউয়ের সাবজেক্ট। অর্থাৎ 'ইতিহাস'।

সমাপ্ত

© FB.com/muktiprakash



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~