জিষ্ণুর ফোনে ফেসবুক নোটিফিকেশন এসেছে, 'মলি ইজ্ লাইভ নাউ'। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এবারের বইমেলা থেকে কেনা মার্ডার মিষ্ট্রির বইটায় ডুবেছিল সে। বই টা উল্টে রেখে দিয়ে ফোন টা তুলে নিয়ে ফেসবুক খুললো জিষ্ণু।
মলির নতুন ফ্ল্যাটে গৃহপ্রবেশ ছিলো আজ দুপুরেই। জিষ্ণু, ময়না, শুভময়, মৈনাক আর মলি কলেজ লাইফের ভালো বন্ধু। দুপুরে ওদের সকলের নিমন্ত্রণ ছিলো। জিষ্ণু গিয়েছিলো দুপুরে। ময়না আর মলির সাথে অনেকক্ষন আড্ডা দিয়েছিলো। সন্ধ্যায় মলি ঐ ফ্ল্যাটেই ডিজে নাইটের আয়োজন করেছে বন্ধুদের আর কলিগদের জন্য। মৈনাক আর শুভময় তখনও আসেনি। ময়নার সন্ধ্যায় আসা হবেনা। তার কিছু জরুরী কাজ আছে। জিষ্ণুও সেই সুযোগে বললো তার একটা টিউশন আছে আর কামাই করা যাবেনা। আসলে এই সব পার্টি বা নাচ-গানে তার ইন্টারেস্ট নেই। তার থেকে বাড়িতে একটা ক্রাইম থ্রীলার সিনেমা দেখা বা একটা মার্ডার মিষ্ট্রি পড়া ঢের ভালো।
ফেসবুক লাইভে মলি সব নিমন্ত্রিত দের ইন্ট্রোডিউস করিয়ে দিচ্ছে। অনেক কমেন্টস্ আসছে কংগ্র্যাচুলেসন্স্ জানিয়ে। মলিকে দেখতে বেশ লাগছে ওয়েস্টার্ন আউটফিটে। গানের তালে তালে উদ্দাম নৃত্যে মেতেছে সকলে। জিষ্ণু একটা লাইক দিলো। দেখলো মৈনাক কমেন্ট করেছে, "আসতে পারলাম না। সরী। বেস্ট উইশেস্।"
মলি থ্যাংক্স বললো। কিছুক্ষণ পর শুভময়-এর কমেন্ট , "হাই। দারুন লাগছে তোকে। আর কি ফাটাফাটি অ্যাম্বিয়েন্স। কলকাতায় থাকলে সিওর যেতাম।" আলো আঁধারি মায়াবী পরিবেশে নিজেকে ভাসিয়ে দিতে দিতে রিপ্লাই দিলো মলি, "দিস্ ইস্ নট্ ডান্ ময়। তোর আসা উচিৎ ছিলো।" শুভময় আবার লিখলো, "সি ইউ সুন, মলি"।
ওফ্, মলির এই শোঅফ মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে জিষ্ণু র। লাল, নীল, সবুজ আলোয় রঙ্গীন পরিবেশে, গানের তালে তালে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে সবাই। লুকানোর চেষ্টা করলেও প্রায় সকলের হাতের গ্লাস আর তাতে থাকা তরল লুকানো যাচ্ছেনা মলির ফোনের হাই রেসোলিউশন ফ্রন্ট ক্যামেরা থেকে। হঠাৎ ক্যামেরার ছবি একটু অবিন্যস্ত ভাবে কেঁপে মলির পায়ের দিকে গেলো আর মলির গলায় শোনা গেলো, "ম য় না ? ... আ... আ..." !!! এরপর ক্যামেরার ছবি এক গতিতে কাঁপতে কাঁপতে অন্ধকার হয়ে গেলো।
জিষ্ণু কিছুক্ষন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইলো.... ময়না কি ওখানে গেছে? ফেসবুক লাইভে ময়নার কোনো রিঅ্যাকশন বা কমেন্ট ও ছিলোনা। কিন্তু ময়না কেনো এমন করবে!!! সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবে বলে ডায়ালার খুলতে গিয়ে দেখে ময়নাই ফোন করেছে...জিষ্ণু ফোন রিসিভ করলো, "হ্যাঁ, তুই কোথায় এখন? তুই কি মলির বাড়ি... কি হয়েছে তোর? তুই মেট্রো স্টেশন এর সামনে দাঁড়া। আমি পাঁচ মিনিটে পৌঁছচ্ছি।" ফোন কেটে টেবিল এ রাখা বইটাকে আবার বন্ধ করে আলমারিতে রেখে দিলো জিষ্ণু। সে যে নিজেই এখন একটা রহস্যের অংশ হয়ে গেছে , ভালোই বুঝতে পারছিলো।
সকাল ৬ টা। মোবাইল টা অন করতেই ১০টা মিস্ড কল অ্যালার্ট আর ১টা মেসেজ ঢুকলো পার্থর ফোনে। লালবাজার ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর পার্থসারথি ঘোষ মেসেজ টা পরে ফোন ব্যাক করলো, "হ্যাঁ স্যার, আসলে রাতে ফোন টায় চার্জ শেষ হয়ে গেছিলো... আচ্ছা আপনি ওদের ওখানে চলে যেতে বলুন, আর আমায় ঠিকানা টা পাঠিয়ে দিন। পৌঁছে যাচ্ছি।"
মলির ফ্ল্যাটের সামনে বেশ লোক জড়ো হয়েছে। মার্ডার বলে কথা তাও ফেসবুকে ভাইরাল। পার্থসারথি সাদা পোশাকে অ্যাপক্যাব থেকে নামলো। কেউ বুঝতে পারেনি পুলিশ বলে। মলির ফ্ল্যাট দোতলায়। সেখানে পৌঁছতেই মোতায়েন পুলিশরা স্যালুট ঠুকলো। মলির বডি টা ঘরের মাঝামাঝি পড়ে আছে। রক্তে ভেসেগেছে তার চারপাশ। রক্তের উৎস মলির মাথার ক্ষত। পার্থসারথি ক্ষতস্থান পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে বললেন "কোনো হাতিয়ার পাওয়া গেছে যেটা দিয়ে এই খুন করা হয়েছে?" সাব-ইন্সপেক্টর মিত্র জানালেন যে সেরম কিছু পুরো ফ্ল্যাট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। সাথে এও জানালেন যে বাইরের ঘরে ভিকটিমের মা আর কিছু বন্ধু বান্ধব আছেন। বডিটাকে পোস্ট মর্টেমে পাঠাতে বলে পার্থসারথি পাশের ঘরে এলো। সোফায় বসেছিলো জিষ্ণু আর ময়না। মলির মাকে স্বান্তনা জানিয়ে এসে পার্থ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো জিষ্ণু আর ময়নার সামনে... "আমি পার্থসারথি ঘোষ, ক্রাইম ব্রাঞ্চ, লালবাজার। তোমাদের কাছে ফেসবুক ভিডিও টা আছে? শুনেছি বাড়িতে বৌএর মুখে। একবার নিজ চক্ষে দেখি।"
জিষ্ণু তার ফোনটা এগিয়ে দিলো। পার্থ পুরো ভিডিও টা মন দিয়ে দেখলো। কয়েকটা জায়গা এগিয়ে পিছিয়ে বারবার দেখলো । "তাহলে ময়না, তুমি বলছো যে পার্টিতে তুমি আসোনি। কিন্তু তাহলে কোন্ ময়না কে দেখেছিলো মলি। ডাইরেক্ট এভিডেন্স কিন্তু তোমার এগেন্স্টে।"
ময়না বললো, "দেখুন স্যার, আমি পার্টিতে আসিনি এখনো বলছি। আমি বাড়িতে ছিলাম ঐ সময়। আর কোন্ ময়না মলির এরম অবস্থা করলো, সেটাও আমি বুঝে উঠতে পারছিনা ।"
পার্থসারথি বললো, "আচ্ছা, ফেসবুকে এই ইভেন্ট টা বানিয়েছিলো মলি। তাহলে তো নিমন্ত্রিত দের লিস্ট টা এখানেই পাওয়া যাবে।" "হ্যাঁ স্যার, আমি দেখাচ্ছি" বলে জিষ্ণু উঠে সাহায্য করতে যাচ্ছিলো। পার্থ তাকে থামিয়ে দিলো, "ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নেই বলেই যে ওটা আমি জানিনা, তোমায় কে বলেছে?" নিমন্ত্রিতদের লিস্ট দেখতে দেখতে কয়েক বার থামলো পার্থ। "মিত্র, আমি সিসিটিভি ফুটেজ দেখবো। এক্ষুনি ব্যবস্থা করো। আর আমি কয়েকজনের নাম পাঠিয়েছি তোমাকে, এদের ফোনের কল ডিটেইলস চাই গত তিনদিনের।" মিত্র ইয়েস স্যার বলে চলে গেলো ।
পার্থসারথি এবার জিষ্ণু আর ময়নাকে বললো, "আচ্ছা, তোমাদের বন্ধুদের মধ্যে তোমরা দু'জন তো দুপুরে এসেছিলে, আর বাকি দু'জন মানে মৈনাক আর শুভময় আসেনি। এর মধ্যে শুভময় কলকাতায় নেই। এরা কোথায় থাকে?"
জিষ্ণু বললো, "মৈনাক-এর পরিবার থাকে মুম্বাই এ । কলেজে পড়াশোনার জন্য সে এসেছিলো কলকাতায়। তারপর যে কোম্পানিতে মলি চাকরি পেয়েছিলো, সেই একই কোম্পানিতে মৈনাক ও জয়েন করে। শুভময় ও সেম। ও বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরে থাকে ।"
পার্থ বললো, "নিমন্ত্রিতদের মধ্যে বয়স্করা সকলেই চলে গেছিলো, মলির মা বলেছেন। সন্ধ্যার পার্টি ছিলো শুধুমাত্র কলিগ আর বন্ধু দের জন্য। নিমন্ত্রিত দের লিস্টে ময়না নামক একজন ই ছিলো, যাকে মলি দেখেছিলো পার্টিতে আর সেই তৎক্ষনাৎ মলিকে খুন করে।"
ময়না ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো"আমি আসিনি পার্টিতে । আর আমি কেনো মলিকে খুন করবো?"
"সময় এলেই জানতে পারবে কেনো। আপাতত এটা আমি সিওর যে ময়না নামটা এই খুনের সাথে জড়িত। তোমাদের বাকি দুই বন্ধুকে খবর দেওয়া হয়েছে। তারা এসে পড়বে যেকোনো মূহুর্তে" ,পার্থ ঘড়ের চারপাশটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললো ।
জিষ্ণু এবার উঠে গিয়ে বললো, "স্যার, আমিও কাল ঘটনা টা লাইভ দেখেছি। আপনার কি মনে হয়না অত গানবাজনার মধ্যে যে 'ময়না' কথাটা আমাদের কানে আসছে, সেটা ময়না না, মৈনাক বলার চেষ্টাও হতে পারে। মানে আমরা যেটাকে 'ময়না' শুনছি সেটা মৈনা... নয়তো?"
পার্থ অন্য দিকে তাকিয়ে বললো, "ডিটেকটিভ নাকি তুমি? নাকি অতিরিক্ত ডিটেকটিভ মুভি দেখে মাথাটা খারাপ করেছো!!!"
জিষ্ণুর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, "স্যার, সেকেন্ড টা। মানে এরকম একটা কেস সল্ভ্ করার ঈচ্ছা অনেক দিনের। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি আপনার সাথে এই কেস টা সল্ভ্ করতে চাই। "
পার্থ বললো, "তাহলে তো তোমার ও মোটিফ আছে খুন করার যাতে এতোদিনের সখটা মেটাতে পারো। যাকগে, তোমরা সবাই সন্দেহের তালিকায় আছো। আপাতত তোমরা আসতে পারো। তোমাদের নাম্বার আমার কাছে আছে। দরকার হলে ডেকে নেবো। শহর ছেড়ে কোথাও যাবেনা।"
সিসিটিভি ফুটেজ দেখছিলো পার্থসারথি আর মিত্র। ভিডিও অনুযায়ী খুনটা হয়েছিল রাত ৯ টা ১৫ নাগাদ। প্রত্যেকটা অফিস কলিগ এর এন্ট্রি নোট করছিলো। রাত সাড়ে ৮ টার মধ্যে মোট ২২জন ফ্ল্যাটে ঢুকলো। ৯টা বেজে ১০ এ ফুটেজ টা থামিয়ে দিলো। কিছু একটা জুম করে দেখলো। আবার চালালো। ৯টা বেজে ১৯ এর ফুটেজে আবার থামালো ।
"আজকালকার ছেলেমেয়েরা সব সিনেমা দেখে দেখে অভ্যস্ত। হুডওয়ালা লম্বা ঝুলের জ্যাকেট পরে এসেছিলো। কাল কি বৃষ্টি হচ্ছিলো নাকি মিত্র। আমার তো মনে পড়ছেনা।"
মিত্র বললো, "স্যার, লাস্ট একসপ্তাহে কোনো বৃষ্টি নেই ।"
পরের ভিডিও ফুটেজ চালিয়ে গুনে গুনে ২২ জন কলিগ বেরিয়েছে কিনা নোট করলো পার্থ, "ঠিক দিকেই এগোচ্ছি মনে হচ্ছে মিত্র।" ঠিক তখনই একজন হাবিলদার এসে খবর দিলো যে মৈনাক এসেছে। আর মিত্র স্যার যে নাম্বার গুলো দিয়েছেন সেই কল ডিটেইলস্ এসে গেছে। কল ডিটেইলস্ দেখতে দেখতে একটা জায়গায় গিয়ে থেমে গেলো পার্থর চোখ।
"হ্যালো মৈনাক, আমি ইন্সপেক্টর পার্থসারথি ঘোষ। কালকে যখন ঘটনাটা ঘটছিলো, তুমি কোথায় ছিলে। তুমি তো কমেন্ট ও করেছো ।"
মৈনাক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, "একটু ব্যক্তিগত কাজ ছিলো। পারিবারিক ব্যাপার। সেখানে যাওয়ার পথেই কমেন্ট করেছিলাম।"
পার্থ বললো, "ময়না এখন প্রাইম সাস্পেক্ট বুঝতেই পারছো । তোমার কি মনে হয়?"
"কার মনে কি আছে, বলা খুব মুস্কিল। কে জানতো এরকম একটা ঘটনা আমাদের বন্ধুদের মধ্যে ঘটবে। এছাড়াও আরেক টা অদ্ভুত ব্যাপার সেদিনের ভিডিও টায় দেখলাম। আমাদের আরেক বন্ধু শুভময় বলেছিলো, সে কলকাতায় নেই, সে তো কলকাতাতেই আছে, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন",মৈনাক বললো।
"তাই নাকি!!আচ্ছা, তোমার সাথে মলির সম্পর্ক কেমন ছিলো?" পাল্টা প্রশ্ন পার্থর।
"আমরা কলেজের পরে একই অফিসে চাকরি পেয়েছিলাম । কলেজ লাইফের বন্ধুত্ব আরো ভালো হয়েছিলো।" , মৈনাক বললো।
"তোমার বাড়িতে কে আছে?"
"আমি একাই থাকি স্যার।"
"ঠিক আছে, তুমি আসতে পারো। শহর ছেড়ে কোথাও যেওনা ।"
মৈনাক চলে যেতে পার্থ বললো, "মিত্র, খিদে টা খুব জোর পেয়েছে। চলো সামনের হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নি।"
"মিত্র, তুমি তো চিকেন এখোনো ধরোনি। ভাগার কাণ্ডের রেশ। দাদা, একটা চিকেন থালি আর একটা এগ থালি দেবেন।" অর্ডার দিলো পার্থ ।
"বাড়িতে রান্না হলে খাই তো" মিত্র হেঁসে বললো,"স্যার, কেসটা কিছু বুঝতে পারলেন"
"অনেক গুলো ব্যাপারে ধোঁয়াশা আছে মিত্র...
ময়না পার্টিতে কি গেছিলো? মলিকে খুন করার কি মোটিফ ময়নার? যদি ময়না না যায়, তাহলে সিসিটিভি ফুটেছে কাকে দেখলাম আর মলি ময়নার নাম নিলো কেনো? জিষ্ণু ময়না কে বাঁচাতে চাইছে আর মৈনাকের নামে দায় চাপাতে চাইছে কেনো? মৈনাকের সম্পর্ক বাকিদের সাথে কেমন? জিষ্ণুকে কাল রাতে ঘটনাটা ঘটার কয়েক মিনিটের মধ্যে ফোন কেনো করেছিলো ময়না? মৈনাক তো মলির ইন্ভাইটি লিস্টে ছিলোনা, তাহলে পার্টির কথা জানলো কিভাবে? আর শুভময় কি কলকাতায়?" ....
খেয়ে দেয়ে মর্গে চলে এসেছে পার্থসারথি আর মিত্র। পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট টা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। যিনি পোস্ট মর্টেম করেছেন তার সাথে কথা বলে রিপোর্ট নিলো ওরা ।
"মাথাটা ধরে গেছে। একটু চা খেতে হবে।"
"চলুন স্যার, সামনেই দোকান।" চা খেতে খেতে পার্থ দেখলো, সামনের বাড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলে দুই তলায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলেকে ডাকছে, "কিরে, খেলতে আয়। আয় না ।"
এটা শুনে পার্থসারথি থ হয়ে গেলো।
"মিত্র, ইমিডিয়েট শুভময় এর বাড়ি চলো । ইস্ এই ব্যাপার টা তো মাথায় আসেনি !!"
মিত্র চমকে উঠে কোনোমতে চা এর ভাঁড় টা ফেলে গাড়ীর দিকে ছুটলো।
"স্যার, কি হয়েছে। কিছু ক্লু পেলেন নাকী? "
পার্থ ততক্ষণে মিত্র র মোবাইলে মলির করা ভিডিও টা চালিয়ে ফরোয়ার্ড করে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে বললো, এবার শোনো মলি শুভময় কে কি নামে ডাকছে.... ময়। তাহলে ওই ময়না মানে তো "ময় না" ও হতে পারে। হয়তো মলি শুভময়ের হাতের অস্ত্র দেখে বারণ করতে চেয়েছিলো!!!"
মিত্র বললো, "আর মৈনাকের কথা অনুযায়ী শুভময় কাল রাতে কলকাতায় ছিলো। স্যার, হিসাব মিলে যাচ্ছে।"
শুভময়ের বাড়িতে এসে কলিং বেল বাজাতে একজন বেরিয়ে এলেন । "শুভময় আছে? আমরা ক্রাইম ব্রাঞ্চ থেকে আসছি।" শুভময় বেরিয়ে আসতে পার্থ বললো, "শুভময়, আমরা ভিতরে বসি? অনেকটা সময় লাগবে।"
রাত ৭:৩০ টা নাগাদ মিত্র ফোন করে জিষ্ণু, ময়না আর মৈনাক কে আধ ঘন্টার মধ্যে রেডি থাকতে বললো। বৃষ্টি নেমেছে , সে গাড়ি নিয়ে পৌঁছে যাবে ।
"আগে জিষ্ণু, তারপর মৈনাক আর শেষে ময়না। মনে থাকবে তো মিত্র।"
"একদম থাকবে, স্যার ।"
রাত ৯টা নাগাদ সবাই বসে আছে শুভময়ের বাড়িতে । পার্থসারথি বলতে শুরু করল, "আমরা কেসটা সল্ভ্ করে ফেলেছি। গতকাল ঠিক এরকম সময়েই তোমাদের বন্ধু মলি খুন হয়। তার শেষ কথাটা ছিলো 'ময়না'। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ চেক করেছি। যে ২২ জন মলির অফিসের কলিগ ছিলো, সবাই ঘটনাটা ঘটার অনেক পরেই বেরিয়েছিলো। তবে আর একজন এসেছিলো মাত্র কিছুক্ষণের জন্য এবং সেই একজন এই ঘরেই আছে । ময়নার উপর সন্দেহ তৈরী হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনা স্হলে পৌঁছে আর ময়নাকে দেখে আমি বুঝতে পারি যে ময়নার পক্ষে এই কাজ করা অসম্ভব । মলির ঊচ্চতা ৫'৮" আর সাথে পরেছিলো ৩" মতো উঁচু হিল । ময়না খুব বেশী হলে ৫'৩" আর আঘাত টা হয়েছিলো মাথায়। তাই ময়না বাদ, তাইতো জিষ্ণু । তাহলে মলি কেনো 'ময়না' বললো । মলি তো শুভময়কে ময় বলে ডাকতো। তাহলে "ময় না" বলেনি তো? শুভময়ের সাথে কথা বল্লাম । মৈনাক, ও সত্যিই কাল কলকাতায় ছিলোনা । বাবা মা কে নিয়ে মালদায় ওর মাসির বাড়ি গেছিলো। ছবিসহ সব প্রমাণ পেয়েছি । কিন্তু শুভময়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে দুদিন আগে তার সাথে মৈনাকের দেখা হয় আর মৈনাক তখন ছাতার দোকান থেকে বেরোচ্ছিলো। আরো জানতে পারলাম যে মৈনাক আর মলির মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো বছর খানেক আগে। তখন, শুভময় ও তাদের সাথেই কাজ করতো। অফিসের কাজে তিনজনে যখন মুম্বাই গেছিলো, তখন মৈনাক ওর মা-র সাথে আলাপ করায় মলির । মা এর মন ভেবে বসেছিলো যে সেই তার হবু বৌমা । কিন্তু মলির চরিত্র খুব একটা ভালো ছিলোনা । মৈনাকের মা এর চোখে একবার মলি অন্য কোনো এক পুরুষের সাথে ধরা পরে মলির ফ্ল্যাটে । হবু পুত্রবধূ কে শাসন করতে গিয়ে উল্টে অপমানিত হয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। উনি খুব ভেঙ্গে পড়েন আর অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্টে প্রাণ হারান । কিন্তু মৈনাক সেই থেকে মলিকেই তার মার মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করে। মৈনাকের রুমমেট হিসাবে এটা শুভময়ের মত। মৈনাক, আমি কিছু ভুল বললে অবশ্যই বোলো ।" কিছু ক্ষণ থামলো পার্থ ।
"কিন্তু আমি আবার গিয়ে আটকালাম 'ময়না' তে। ময়না গতকাল ঘটনা ঘটার কিছুক্ষনের মধ্যে জিষ্ণুকে ফোন করে সম্পূর্ণ অন্য এক কারণে। ময়না, তোমার পারিবারিক সমস্যা যেটা তুমি গতকাল জিষ্ণুকে বলেছিলে, যতটুকু দরকার, ঠিক ততটাই বলবো। ময়না র বাবা গত বেশ কয়েক বছর এক অন্য মহিলার সাথে সম্পর্ক রেখে চলেছিলেন গোপনে। কর্মসূত্রে তিনি সেই মহিলার সাথে দেখা করতে যেতেন। এই সম্পর্কে একটি পুত্র সন্তান হয় তাদের কিন্তু ময়নার বাবা কোনোদিনই সেই ছেলেটিকে পিতৃপরিচয় দিতে পারেননি।গতকাল সন্ধ্যায় ময়নার বাবা ছেলেটিকে তাঁদের বাড়িতে ডাকেন কারণ তাঁর মনে হয় ছেলেটিকে তার প্রাপ্য সম্পত্তি র ভাগ দিতে হবে। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর রাজারহাটের বাড়িটা দিতে ছেলেটিকে যাতে সে নিজের মতো করে সেটা কাজে লাগাতে পারে। এদিকে মলি আর ময়না ঠিক করেছিলো ঐ বাড়িটাতে পার্লার খুলবে। ময়না মলিকে আশ্বস্ত করেছিলো যে তার বাবাকে ম্যানেজ করে বাড়িটা পেয়ে যাবে। তাই ময়নার বাবার প্রস্তাব শুনে ময়না চুড়ান্ত আপত্তি জানায়। ছেলেটির সাথে খুব তর্কাতর্কি হয় ময়নার। ছেলেটিকে বের করে দেওয়া হয়। কি তাইতো মৈনাক?"
মৈনাক কিছুক্ষণ ভেবে বললো, "মা মারা যাওয়ার পর ওনাকে জানাই। আমার চাকরি টা ততদিনে চলে গেছে। উপায় ছিলোনা।"
"চাকরি কেনো গেলো সেটা শুভময়ের থেকে জেনে নিয়েছি। মলিকে তুমি লাইফ থ্রেট দিয়েছিলে তোমার মা'র মৃত্যুর পর। মলি তাই সাজিয়ে তোমার নামে সেক্সুয়্যাল অ্যাসল্ট এর চার্জ আনে আর তোমার চাকরি টা চলে যায়।"
পার্থ বলে চললো, "কিন্তু 'ময়না' কথাটা কেনো আর খুনের অস্ত্র টা কী, আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। এখানে আমার আগেই এই কেসটা একজন সল্ভ্ করে ফেলেছিলো আর আমাকে ভুল একটা আইডিয়া দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করেছিলো। তাই তো জিষ্ণু।"
জিষ্ণু চুপ করে রইলো ।
"ভিডিও টা অনেক বার দেখলাম । মলি বলেছিলো 'ময়না', 'মৈনা...' নয়। মানে কোনো ভাবেই মৈনাকের নাম নিতে চায়নি মলি। তুমি বাকিটা বলবে নাকি জিষ্ণু?" পার্থ থামলো ।
জিষ্ণু বলতে শুরু করলো,"ময়নার কাছ থেকে জানতে পারি যে কাল বিকালে মৈনাকের হাতে একটা ছাতা ছিলো । কিন্তু শেষ ক'দিন তো বৃষ্টি হয়নি আর গতকাল ও আকাশ পরিষ্কার ছিলো। সকালে মলির মাথার ক্ষতটা দেখে বুঝলাম যে সরু রড টাইপের কিছু একটা ধারালো বস্তু মাথা টা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। বিকালে পার্থসারথি স্যার এখান থেকেই ফোন করেন আমাকে। ময়না কাল ঘটনা টার পরে কেনো ফোন করেছিলো, ওনাকে বলতে বাধ্য হই পুরোটা। ওনার কাছ থেকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, সিসিটিভি ফুটেজ আর ছাতার দোকান থেকে মৈনাককে বেরোতে দেখার কথা জানতে পারি । বাকিটা দুইএ দুইএ চার করে নিলাম। স্যারের কথা মতোই আমি আসার সময়ে ছাতার দোকান থেকে ব্যাপার টা কনফার্ম করে আসি। ছাতার একটা রড খুলিয়ে সেখানে লোহার রড লাগাতে বলা হয়েছিল । রডের খোলা দিকটা তীরের মতো ছুঁচালো। বেশী টাকা দিয়ে দোকানীকে ব্যাপার টা গোপন রাখতেও বলা হয়েছিলো । কিন্তু পুলিশ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে সে সব বলে দিয়েছে ।"
পার্থ যোগ করলো, "সিসিটিভি ফুটেজে যে হুড ওয়ালা জ্যাকেট পরা ব্যক্তিকে দেখেছিলাম তার হাতেও ছাতা ছিলো। কিন্তু বেরোনোর সময় সেই ছাতা খোলা ছিলো। তাড়াহুড়ো য় ছাতায় আবার লোহার রডটা লাগাতে পারেনি বেচারা। কিন্তু জিষ্ণু, মলি তাহলে ময়না কেনো বলেছিলো? ময়না তো সেখানে ছিলোনা।"
জিষ্ণু বললো, "স্যার, ময়না বলা মানেই কি সামনে ময়নাকে দেখা? আমি যদি এখন একটা কাগজে টিয়া লিখে হঠাৎ আপনার চোখের সামনে ধরি, আপনি কি অবাক হয়ে 'টিয়া' বলবেন না? এক্ষেত্রেও আমার মনে হয়, সেরকমই কিছু ঘটেছিলো। কিন্তু ঐ আলোআঁধারি পরিবেশে কাগজে লেখার থেকে মোবাইলে 'ময়না' লিখে মলির সামনে ধরাটাই সুবিধাজনক ছিলো। তাইতো মৈনাক? এতে মলির উপর বহুদিনের রাগ ও মিটলো, আবার ময়নাকে জড়িয়ে ফেলাও গেলো। এতে তোমার প্রাপ্য বাড়িটা পেতে কোনো বাঁধা রইলোনা।"
সাব-ইন্স্পেক্টর মিত্র ঘরে ঢুকলো, "এই নিন স্যার, খুনের অস্ত্র। মৈনাকের বাড়িতে তালা ভেঙ্গে ঢুকে ঊদ্ধার হয়েছে ।" পার্থ পলিথিনের মধ্যে থাকা ছাতা আর তার সাথে থাকা লোহার রডটা সবাইকে একবার দেখালো।
মৈনাককে নিয়ে থানায় চলে গেছে মিত্র। শুভময়ের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পার্থসারথি আর জিষ্ণু।
পার্থ বললো, "থ্যাংক্স, তুমি হেল্প না করলে এই কেসটা সল্ভ্ করা হয়তো যেতোনা। জানোতো, জিষ্ণু হলো অর্জুনের আরেক নাম। আর পার্থসারথি মানে অর্জুনের সারথি। তুমি চাইলে ভবিষ্যতে তোমার যেকোনো রহস্য সমাধানে আমি তোমায় পথ দেখাতে পারি। তুমি চেষ্টা করো। তোমার হবে। আর ময়নাকে বাঁচানোর এই চেষ্টা কি শুধুমাত্র বন্ধুত্বের খাতিরেই নাকি আরো বেশী কিছু। নিজের মধ্যে চেপে না রেখে মনে যা আছে, ওকে বলে দাও।"
জিষ্ণু পার্থসারথির সাথে করমর্দন করলো ।বললো, "আমাদের পার্টনারশিপ টা জমবে মনে হচ্ছে, স্যার"।
সমাপ্ত
© FB.com/pranjal.dutta.940