সত্যি জীবনে যা একান্ত ভাবে চাওয়া যায় তা পাওয়া যায়না--
বিছানায় সেলাই করা ফাটা কপাল টা নিয়ে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল গৃহ বধূ শ্যামা-- তারমতন মধ্যবিত্ত গ্রামের এক সাধারন কালো মেয়ের জন্য হয়তো চাওয়াটা অনেক বেশি হয়ে গিয়েছিল-- কিন্তু তপুদা সেদিন কি তুমি আজকের তপেশ চ্যাটার্জী ছিলে --? সেদিন তো গ্রামের স্কুলে পড়া একটি ছেলে-- থাকতে জ্যাঠার বাড়ীতে-- বাবা মা তোমার ছিলনা-- অবশ্য জ্যাঠারা তোমাকে ভালোইবাসত--।
তুমি যখন ১১ ক্লাসে পড়তে আমি তখন সেভেনে পড়তাম গ্রামের বালিকা বিদ্যালয়ে-- সন্ধ্যা বেলায় বেশ কিছু ছেলেমেয়ে নিয়ে তোমার জ্যাঠার বাড়ীর দাওয়ায় পড়াতে বসতে-- নিজের খরচটা নিজেই চালাতে-- খুব মেধাবী ছিলে তুমি--।
তোমায় আমি ভালোবাসব এতটা দুঃসাহস ছিলনা-- সবাই বলত ও তো কালো মেয়ে-- তুমিই প্রথম স্বপ্নের কাজলটা আমার চোখে পরিয়েছিলে-- বলেছিলে আমায় -- বল তো তোকে আমি কলি বলে ডাকি কেন?
আমি বলেছিলাম-- কেন?
জানিস না?
না--
তবে শোন রবিঠাকুরের এই গানটা--
বলে গেয়েছিলে আমার হাত ধরে ধানখেতের ধারে আল পথের ওপর দিয়ে যেতে যেতে-- তখন সবে সূর্যটা ডুবেছে-- আকাশের পশ্চিমকোণটায় তখনও লাল আভা লেগে রয়েছে-- কি সুন্দর গাইলে তুমি, " কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক,"।
হঠাৎ কঠিন কণ্ঠে বউমা ডাক শুনে সেদিনের কৃষ্ণকলি আজকের শ্যামার চিন্তার জাল টা ছিন্ন হয়ে কেটে গেল-- তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়ে মাথাটা টলে গেল--- তা দেখে শাশুড়ি বলে উঠলেন দেখাচ্ছ বটে তুমি দুটো সেলাই পরল কি না পরল তাতে মাথা যেন আর তুলতে পারেনা--
শ্যামা তাড়াতাড়ি বলল-- না মা এখনি উঠছি--
হ্যাঁ ওঠো তো বাপু রাতের রান্নাটা কর-- আমি আর পারিনা- কমলা উনুন ধরিয়ে দিচ্ছে --
শ্যামা টলতে টলতে রান্না ঘরে চলে গেল---।
স্বামী ঘরে ফিরলে চা আর চিঁড়ে ভাজা নিয়ে এসে কাঁপা হাতে সামনে দাঁড়ায় -- একটু কঠিন একটু স্নেহের সুর মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভাত পেটে পরেছে?
ঘাড় নেড়ে জবাব দিল-- না
স্বামী বলল-- বাক্যি হরে গেল যে? আরে কি করে জানব একটা ধাক্কাতেই ঘুরে খাটের কোণায় লেগে মাথা ফাটাবে? তা তার জন্য তো চারটি পয়সা খরচ করে ডাক্তার ডেকে সেলাই দেওয়ালাম-- তা সেদিন তুমি ভালো বাঁচিয়েছ আমায় -- ভাগ্যিস ডাক্তারকে বললে কলতলায় পরে গিয়ে মাথা ফাটিয়েছ-- তা ভালো স্বামীর জন্য মাঝেমাঝে মিথ্যে বলাই সতিসাদ্ধীর কাজ।
হঠাৎ সেদিন বিকেলেই মায়ের তার আসে -- মায়ের শরীর খারাপ তাই মামা নিতে আসছে -- স্বামী শুনে বলল-- তা ভালোই হল-- কদিন বিশ্রাম নিয়ে এসো আর হ্যাঁ ওখানে গিয়ে এই কথাটাই বোল যে কলতলায় পরে গিয়েছিলে--।
গ্রামে যাবার নামে তোমার কথাটাই মনে এলো -- সেই যে গেলে কলকাতায় চাকরি করতে-- যাবার আগে বলেও গেলে আমায় অপেক্ষা করতে-- কিন্তু কতদিন আর অপেক্ষা করব বল? তারপর তো শুনলাম তুমি বম্বে চলে গেছ-- রূপালি পর্দার জগতে-- কত নামকরা লোক হয়ে গেছ তুমি-- বুঝলাম তুমি ভুলে গেছ -- রঙিন জগতে গিয়ে গ্রামের সেই বেরঙা কৃষ্ণকলিকে --।
তোমার চোখে কৃষ্ণকলি হলেও আর সবার চোখে যে আমি একটা কালো মেয়ে-- তাই বিয়েও হল আধা শহর আধা গ্রামের এক কেরানীর সাথে-- স্বপ্ন আমার তলিয়ে গেল -- কেন যে আমায় স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিলে কে জানে? কাগজে দেখলাম তুমি কলকাতায় এসেছ-- খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তোমার সাথে একবার দেখা করার-- কিন্তু তোমার কাছে তো পৌঁছাতে পারবনা-- তুমি যে এখন মস্ত লোক-- আর আমার মতন একজন ডুরে শাড়ি পরা গ্রাম্য মেয়ে তোমার সাথে দেখা করতে গেলে তো তুমি লজ্জায় পরে যেতে -- তুমি আমায় বলতে আমার সৌন্দর্য আমার চোখ-- একবার তাকালে বুকে নাকি আগুন জ্বলে ওঠে-- কি জানি তবু এই আগুন জ্বলা চোখ নিয়েও কেন বস করতে পারলামনা কাউকে--।
কখনও শাশুড়ির লাঞ্ছনা, সারাদিনের পরিশ্রমের পর স্বামীর রাতের চাহিদা মেটানো, আর কখনও বা তার হাতে মার খেয়ে কপাল ফাটানো এই করেই তো কেটে যায় গ্রামের সাধারন কালো মেয়েদের জীবন তাইনা? তবু বাপের বাড়ী যাবো বলে সুটকেসে রাখা তোমার দেওয়া সেই দুগাছি চুড়ি বার করলাম-- সেই যে গো যাবার আগে তুমি চৈত্র মাসের চড়কের মেলা থেকে পাথর বসানো দামী যে দু গাছা কিনে দিয়ে গিয়েছিলে সেই দু গা ছার কথাই বলছিলাম--- গ্রামে নেমে ভ্যানগাড়ীতে চেপে সেই দুগাছা লুকিয়ে পরে নিলাম--।
যেতে যেতে মামা বলল-- জানিস তপু এসেছে আজ আমাদের গ্রামে -- দিদি তো তাই তোকে আনবার জন্য আমায় পাঠালো--
আমি তো অবাক শুনে-- বললাম তা আমি গিয়ে করব টা কি?
এদিকে তো দেখা হবার জন্য প্রাণটা হাঁপিয়ে উঠেছিল-- বাড়ী পৌঁছে দেখলাম মা আমার ভালোই আছে-- আমায় দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে বলল-- কি চেহারা করেছিস মা? কপাল কাটল কি করে? আবার মেরেছে?
-- রাখো তো এসব কথা-- ফাটা কপাল ফাটবে না তো কি হবে? মা আমার ছেলে মেয়েকে কাঁসার রেকাবে করে নারকোল তক্তি, মুগের নাড়ু, জমাট ক্ষীরের বরফি কত কি সাজিয়ে দিল-- তারপর আমার কাছে এসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-- তোর কথা শুনে যদি তোকে কলকাতায় কলেজে পড়তে পাঠাতাম-- তাহলে আজ তোর এ দশা হত না--
-- ছাড়ো না মা -- যা হয়নি তা নিয়ে আর ভেবে কি করবে-- আমায় একটু খেতে দাওতো-- কতদিন তোমার হাতের চা খাইনি--।
সন্ধ্যাবেলায় তুমি এলে আমাদের দাওয়ায়-- মা তাড়াতাড়ি তোমায় আসন পেতে দিয়ে বলল-- আমি জানতাম তুই একবার হলেও আমার কাছে আসবি--
-- তুমি বললে -- কেন আসব না জ্যাঠাইমা? তোমাদের জন্যেই তো এলাম--
আমি আর থাকতে না পেরে বলে ফেললাম -- হ্যাঁ সাত বছর পর--।
তুমি আমার দিকে তাকালে এতক্ষণ পর-- তারপর মুখ নীচু করে নিলে।
মা তোমার চা করতে ভেতরে গেলে তুমি আমায় বললে-- কোথায় হারিয়ে গেল আমার কৃষ্ণকলি?
-- আমি হেসে বললাম -- এটা আবার কোন সিনেমার ডায়লগ?
তুমি বললে আমি জানি তুমি এ কথাই বলবে কিন্তু ---
- আমি আর কিছু শুনতে চাইনা-- যা হবার হয়ে গেছে আর তো তাকে ফেরানো জাবেনা--
-- কেন জাবেনা? ভেঙে দেব আমি এই পুতুল খেলার বিয়েটা--
তারপর?
তারপর আমি তোমায় নিয়ে যাবো--
- কোথায় নিয়ে যাবে? সিনেমায় নামাতে?
না নিজের করে কাছে রাখতে -- স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে--
আমি হো হো করে হেসে উঠে বললাম -- জীবনটা সিনেমা নয় তপুদা-- তুমি চলে যাও এখান থেকে আর কোনোদিন যেন তোমার সাথে আমার দেখা না হয়--
আমি ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়ে গেলাম অন্ধকারের মধ্যে--
অন্ধকারেই তোমার গলা ভেসে আসতে লাগলো -- কলি কলি যাস না, শুনে যা আমার কথা---
আমি চিতকার করে জবাব দিলাম -- তোমার কলি মরে গেছে তপুদা -- আজ যাকে দেখলে সে তার প্রেতাত্মা ।
সমাপ্ত
© FB.com/paromita.chatterjee2