Durgatinashini - A bengali story

Jolchobi

দূর্গতিনাশিনী

অভিষেক কবি

স্তনের ওপর হাতের থাবা, দিনটা আজও ভুলতে পারেনি মনোরমা। সাদা সালোয়ার কামিজের ওপর সবুজ রঙের দাগটা হয়তো মা সাবান দিয়ে ধুয়ে দিয়েছে কিন্তু মা বাবার অপমান মাখানো মুখটা আজও ভুলতে পারেনি মনি। আজ তার প্রতিশোধ এর পালা।

ঘটনাটা ঘটেছিল বছর কয়েক আগে। মেদিনিপুরের ছোট্ট গ্রাম তালতলা। সেখানেই বাড়ি মনোরমার। বাবা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, মা গৃহবধু। একটা ভাই ক্লাস এইটে পড়ে নাম টুবান। সব মিলে স্বছল মধ্যবিত্ত পরিবার। মেয়ে বলে মনির বাবা সুশান্তবাবু তার পড়াশোনায় অবহেলা করেননি কখনও। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরিক্ষায় প্রত্যাশা মত খুব ভাল ফল করে মনোরমা। এদিকে একদল রাজনৈতিক মদত পুষ্ট গুন্ডা গ্রামের সবাই কে অতিষ্ট করতো। চাদাঁ, মদ, মস্তানি, কটুক্তি কিছুই বাদ যায়নি এদের দয়ায়। এদের জ্বালায় গ্রামের মেয়ে বউরা মোড়ের মাথায় যেতে ভয় পেত। এর মধ্যেও ভালই ছিল তালতলা গ্রামের দিনলিপি।সেদিন ছিল দোলযাত্রার দিন সকাল বেলা। বান্ধবী আর পাড়ার বৌদিদের সাথে রঙ খেলায় মগ্ন মনি। উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে এবছর সে কলেজে। এর মধ্যে গ্রামের গুন্ডা নরেন তার দলবল নিয়ে হাজির হল গ্রামের মধ্যে। মদের গন্ধে আর বাইকের শব্দে গোটা পাড়া নিমেষের মধ্যে দুষিত হয়ে উঠল। একটা নিরমল পরিবেশ তলিয়ে গেল লালশার অন্ধকারে। সবাই নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বাইকের শব্দ ভেদ করে নরেন আওয়াজ দিল।

- তপনা, কোন মালটা বলছিলি বে।
- দাদা, ওই সাদা সালোয়ার। (আংগুল তুলে মনিকে ইংগিত করে)
- দেখ ১০০০ বাজি ধরেছিস।
- দেব দেব তুমি সাইজ তো বল।
- ধুর বাল, এরকম করে কি সাইজ বলা যায় নাকি? দাড়া ধরে দেখি।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই নরেন রংমাখা দু'টি হাত রেখে দেয় মনরমার বুকের ওপর।
- ভাই ৩৪ হবে।

ঘটনা ঘটিয়ে সদলবলে চম্পটদেয় নরেন। এদিকে নরেনের বাবা বিকাশ বাবু এম এল এ হওয়ার সুবাদে পুলিশ কেসও হয়না। গ্রামের বিজ্ঞজনেরা নানা ভাবে মনিকেই দোষি করতে থাকে। ওড়না নিলে, বাড়ির বাইরে না বেরলে, পড়াশোনা না করলে, সালোয়ার না পরে শাড়ি পরলে নাকি এসব বিপদ হত না। সব দোষ নাকি মনির। মনির বাবা সুশান্ত বাবুকেও অনেক শালীনতার শিক্ষা নিতে হয় ওদের কাছে। মনির মা বিমলা দেবী নাকি ভাল মা হতে পারেনি। মেয়েকে নাকি আরও সংযমি হতে হত। সুশান্ত বাবুর দৃড়তা আর মনির অস্বাভাবিক মনের জোর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দিল। গ্রামের লোকজন সবকিছু ভুলে আবার সাবলিল হয়ে উঠল।

কিছুদিন পর একদিন দুপুর বেলায় কোচিং করে বাড়ি ফিরছিল মনোরমা। গ্রামের শুরুতে মোড়ের মাথায় দুচারটে দোকান আছে, গরমের জন্য দুপুরে বন্ধ থাকে। খানিকটা দূরে একটা পোড়োবাড়ি, ফেরার সময় সেই বাড়ির পাশ দিয়েই যেতে হয় ওদের। কিছুটা এগোনোর পর ওই বাড়িটা থেকে একটা অদ্ভুত গোংগানির শব্দ কানে এল মনির। কৌতুহল বশত এগিয়ে গেল সামনে। একি! এতো বাগদি পাড়ার কুসুম। নরেন ও তার দুজন সাগরেদ খুবলে খাচ্ছে কুসুমের শরীরটা। একবার ভাবল ছুটে গিয়ে বাঁচায়, কিন্তু পরক্ষণেই বাস্তবে ফিরে এল। একার পক্ষে বাঁচানো সম্ভব নয়। তাহলে কি করবে? গ্রামে গিয়ে সবাইকে ডাকবে? তত ক্ষনে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাহলে পুলিশকে ফোন করি? তাতেও লাভ নেই। সবতো ওদেরি দলে। ফোনের কথা মনে পড়তেই বেগ থেকে ফোনটা বের করে আগে সাইলেন্ট করল মনি তারপর ক্যামেরা বন্দি করল দুস্কর্মটাকে। তারপর উপায় না দেখে ধীরে ধীরে পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। বাড়ি গিয়ে সমস্ত ঘটনা বাবাকে জানায়। মা পরামর্শ দেন চুপ থাকার। শিক্ষক সুশান্ত বাবু চিন্তায় পড়ে যান কি করবেন ভেবে। মনে মনে ভাবে "আমি কি পারবো লড়াই করতে?" মেয়ে মনি সাহস যোগায়.

- বাবা তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? এবার আমাদের হাতে প্রমান আছে , চলো থানায় যাই। কিছু হবে না, ভয় পেও না।
- না মা , থানা পুলিশ ওদের পকেটস্থ, অন্য কিছু ভাবি দাঁড়া।

বিকেলে কুসুমের ধর্ষিতা হওয়ার খবরটা বিদ্যুতের মতো সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। মিডিয়া, পুলিশ, রাজনৈতিক নেতাদের আনাগোনায় গ্রাম ভোরে ওঠে। এদিকে নরেন ও তার দলবল বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াতে থাকে। রাতের খাবার থালায় বসে খবর দেখতে থাকে সুশান্ত বাবু। তখনই একটা অদ্ভুদ চিন্তা মাথায় আসে।

- মনি মা... এদিকে আসবি মা .....একবার
- আসছি বাবা.......বলো।
- বলছি , তোর ফোনের ভিডিওটা তমলুকের কোন মিডিয়া হাউসে দেখালে কেমন হয়?
- ঠিক বলেছ বাবা ... কাল ই যাই চলো।

পরদিন সকাল সকাল বাবা মেয়েতে বেরিয়ে পড়ে আরেক বাবার মেয়ের নির্যাতনের প্রতিকার খুঁজতে। তপ্ত রোদে এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে তমলুকে এক নামকরা সংবাদ পত্রের অফিসে পৌঁছে যায় ওরা। সেখানে বসে পুরো ঘটনাটা আগাগোড়া জানায় সেই সাংবাদিককে এবং নাম না প্রকাশের অনুরোধ করে ভিডিও টা দেখায়।

- আপনারা কিছু চিন্তা করবেন না .... এতদিনে ওই মাতব্বর বিশাল স্যান্যাল(নরেনের এম এল এ বাবা) কে বাগে পেয়েছি। দেখছি কত ধানে কত চাল।
বোন তুমি এই মেমোরি কার্ডটা আমায় দাও , আমি তোমাকে একটা নতুন মেমোরি কার্ড দিচ্ছি। পুলিশি তদন্ত হলে অরিজিনাল টা আমায় দিতে হবে।
তখন না দেখাতে পারলে আমরা সমস্যায় পড়বো।
- ঠিক আছে দাদা ,দেখবেন আমরা যেন জড়িয়ে না পড়ি। সামনে সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষাতো, বুঝতেই পারছেন। আপনার ফোন নম্বরটা পাওয়া যাবে?
- নিশ্চয়ই..দাঁড়ান আমার কার্ড টা দিয়ে দিচ্ছি। কোন অসুবিধা হলে নির্দ্বিধায় ফোন করুন। কাল সকালের খবরের কাগজে দেখবেন।

বাবা ও মেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে আসে। এদিকে সাংবাদিক রঞ্জিত ধর, ফোন লাগায় নরেনের এম এল এ বাবা বিশাল স্যান্যালকে।

- বিশাল বাবু কেমন আছেন?
- আরে রঞ্জিত .... চলছে .... এলাকায় যা চলছে ......ভালো থাকি কি করে বলতো ?
- তা যা বলেছেন...বিকেলে ফার্ম হাউসে দেখা হবে? জরুরি কথা আছে।
- চলে এস .... কি খাবে সেই রাম? না স্কচ চলবে ?
-- আরে দাদা .... আগে পৌঁছাই তারপর না হয় ঠিক করবো...

যথা সময়ে রঞ্জিত পৌঁছে যায় বিশাল স্যান্যালের ফার্ম হাউসে। অপেক্ষারত বিশাল বাবুকে ল্যাপটপে দেখায় তার ছেলের কীর্তি।
- গাঁড় মেরেছে....... ভিডিও বানিয়ে ফেলেছ? তোমরা কি সুযোগেই থাক? আর আমিও একটা কুলাংগার জন্ম দিয়েছি। বলি, অত যদি রস সোনাগাছি যাওনা বাবা। কচি মেয়ে গুলোকে নষ্ট না করলেই নয়?
- আরে দাদা, সোনাগাছিতে কি আর সে মজাটা আছে। তাছাড়া আপনি কদিন পর মন্ত্রী হবেন আপনার ছেলেকে কি আর ওসব জায়গায় যাওয়া মানায়?

- ভনিতা ছাড়ো বাল..... কত দিতে হবে বল? এই কানু.... ভেতরের ঘরে আলমারিতে সুটকেস আছে নিয়ে আয়তো।

কানু সুটকেসটা নিয়ে এলে বিকাশ বাবু সেখান থেকে ৫০০ টাকার একটা নোটের বান্ডিল বের করে রঞ্জিতের হাতে দেয়।

- এতে চালাও। সামনে ভোট, অনেক খরচা আছে। আর সাংবাদিকতা ছেড়ে ব্ল্যাকমেলিং এর ধান্দা করলেই তো পারতে।

রঞ্জিত একটা নিরলজ্জের হাসি হেসে বিদায় নেয়। তার সাথে বিদায় নেয় নিরযাতিতা কুসুমের হাহাকার। মনি সুশান্তবাবুর বিশ্বাস, আজ গ্রামবাসিরা শান্তির ঘুম ঘুমোবে।

দিন পেরিয়ে বছর গড়ায়। হতাশ কুসুম আত্মহত্যা করে। সুশান্ত বাবু এখন অবসর নিয়েছেন। নরেন এখন এম এল এ। বিকাশ বাবু এম পি। থানার ওসি ঘুস খেয়ে খেয়ে পেল্লাই গতর বাগিয়েছে। একদিন সকাল ৯টায় তালতলা থানার ল্যান্ডলাইন ফোনটা বেজে ওঠে।

- গুড মর্নিং.... তালতলা থানা থেকে বলছি।
- ওসিকে ফোন দিন।
- উনি তো ব্যস্ত, আমায় বলুন।
- চড়িয়ে দাঁত ভেংগে দেব, বলুন এস পি মেদিনিপুর ফোন করেছে।
- সরি সরি....এক মিনিট.. …("স্যার ওপর মহলের ফোন")

ছুটে এসে ওসি ফোনটা ধরে।

- হ্যাঁ........ বলুন
- সমস্ত আনসলভড কেস নিয়ে এখুনি আমার আফিসে আসুন। বিশেষ করে কুসুমের ফাইলটা। এক ঘন্টার বেশি সময় নিলে........ সামলানোর দায়িত্বও আপনার।
- ওকে ম্যাডাম, আপনি নতুন জয়েন করেছেন? নামটা জানতে পারি।
- আমি মনোরমা পোদ্দার..... ডটার ওফ সুশান্ত পোদ্দার... সিস্টার অফ কুসুম বাগদি...... গ্রাম তালতলা....
এখন সব কালপিট জেলের ভেতরে।

সমাপ্ত

© FB.com/abhishek.kabi



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~