১)
অভিরাজের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সে চেয়েছিল ইংরেজিতে এম এ করতে।ভেবেছিল অধ্যাপক হয়ে ছাত্র ছাত্রীদের শেলি, কীটস, বায়রণ, শেক্সপিয়রের কাব্য সুষমা পড়াবে।কিন্তু তৎকালীন বামপন্থী ছাত্র রাজনীতিতে ভেসে গিয়ে আজ সে তিন তিনবার ভোটে জিতে আসা কান্দি গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান। কেবল নিজের সততা ও পরিশ্রমের বিনিময়ে এই তিনু জমানাতেও সে তিন তিনবার বিপুল জন সমর্থন লাভ করেছে।
কিন্তু নিজের ভিতরের সাহিত্য প্রীতিকে সে মরতে দেয়নি। তার সেই সযত্ন লালিত স্বপ্নের প্রতিফলন দেখতে চায় নিজের আত্মজের মধ্যে।একমাত্র ছেলে অভীক এবার সায়েন্সে ৯২ শতাংশ নম্বর নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করল। "কান্দি কলেজেই অভীক ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়বে"--- অভিরাজ বাড়িতে এই ফরমান জারি করে দিল।আর পঞ্চায়েতে বা বাড়িতে,তার সিদ্ধান্তই শেষ কথা।
বাপের কাছে কলকে পাওয়া যাবে না বুঝে অভীক মায়ের আঁচল ধরে ঝুলে পড়ল।
-------- মা, তুমি বাবাকে বোঝাও।ইংরেজি অনার্স নিয়ে পড়ে কোন ভবিষ্যত নেই।আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব।যাদবপুরে চান্স পেয়েছি।
সুনন্দা আঁচল সামলে বললেন----- ওরে ছাড় ছাড়।জানিস তো তোর বাবাকে।একবার গোঁ ধরলে যেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যেসাগর।মানানো মুশকিল।আর তাছাড়া তুই মাকে ছেড়ে কলকাতা চলে যেতে চাস বাবু?
----- মা, আমি গ্রামে পড়ে থাকতে চাই না।যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া যে কোন ছাত্রের স্বপ্ন। আমি ইলেকট্রনিকস নিয়ে পড়তে চাই। আর কলকাতা কতটুকুই বা দূর!প্রতি সপ্তাহে আসব তো।
সুনন্দা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন----আচ্ছা বেশ। তোর যখন এত ইচ্ছা দেখি কি করতে পারি।
২)
অভিরাজ পঞ্চায়েত থেকে বাড়ি ফিরে একটা হার্ট বিট মিস করল। ঘরে দেবী বসে আছে। হেসে হেসে গল্প করছে সুনন্দার সঙ্গে। দেবযানী ওর দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি বোন।সেই ছোটবেলা থেকেই ওকে দেখলেই বুকের বাঁ দিকে মধুর ব্যথা হয়।সেই হৃদয় দৌর্বল্যের কথা দেবযানী জানে। কিন্তু সুনন্দা জানে না।বাবা মায়ের পছন্দের মেয়ে সুনন্দাকেই বিয়ে করেছে অভিরাজ। আঠার বছর সংসার করছে।কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণে সুনন্দা অপছন্দ করে দেবযানীকে। কোনদিন কোন কুৎসা রটেনি অভিরাজ দেবযানীর নামে।ওরা ওদের পারিবারিক সুনাম ও সম্মানের বিষয়ে সচেতন ছিল, সংযমী ছিল।তবু সুনন্দা চিরদিন দূরে দূরে থেকেছে ননদিনীর কাছ থেকে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি একেই বলে?
দেবযানী অভিরাজের অপ্রস্তুত অবস্থা কাটাতে বলল-----হাঁ হয়ে গেলে যে অভিদা? চিনতে পারছ না নাকি!তাড়িয়েই দেবে মনে হচ্ছে বৌদি।
সুনন্দা আগ বাড়িয়ে বলল------মোটেই না।এতদিন পরে সুন্দরী বোনকে দেখে তোমার দাদা খুবই খুশি হয়েছে।এত খুশি যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছে না।
অভিরাজ সুনন্দার শ্লেষটুকু এড়িয়ে বলল----এ কী সারপ্রাইজ রে দেবী!একেবারে না বলে কয়ে হাজির যে?সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো?
দেবযানী ---- সব ঠিকঠাক। এমনি আসতে নেই বুঝি?কলকাতায় দম আটকে আসছিল। গ্রামে দুদিন জিরোতে এলাম।
দেবযানী কলকাতার কমলা গার্লস হাই স্কুলের ভূগোলের শিক্ষিকা।আটত্রিশ বছর বয়স। অবিবাহিতা।
অভিরাজ বলল-----সে আর বেশী কথা কি।দুদিন কেন দুই মাস থাক না।মমতা ব্যানার্জি তো স্কুলের গরমের ছুটি বাড়িয়েই চলেছে।
আজ প্রায় পাঁচ বছর পর হঠাৎই কেন দেবী এ বাড়িতে এল, ভাবতে ভাবতে স্নান করতে গেল অভিরাজ।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর অভিরাজ দোতলায় উঠল।রোজই সে এই সময় দোতলার ঘরে ঘন্টা খানেক পার্টির কাজ করে।তবে আজ সে অনুভব করল সুনন্দার খর চোখজোড়া তাকে অনুসরণ করছে। কারণ দেবযানীর শোবার ব্যবস্থা দোতলায় হয়েছে।
দেবযানীর ঘরে নক করে ঢুকল অভিরাজ। দেবযানী তখন শোয়ার তোড়জোড় করছে অভিরাজ বলল----কেমন আছিস দেবী?
-----ভালো আছি অভিদা।এই বেশ ভালো আছি।কমলা গার্লস হাই স্কুলের ভূগোলের দিদিমণি।
-------এখনও বামপন্থায় বিশ্বাস করিস??
-------করি।অবশ্যই করি।এখনও প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা সকলেই করেন।দল খারাপ কিন্তু মতাদর্শ তো খারাপ ছিল না।জানো, আমার এই বিরুদ্ধ মতের জন্যে মাস্টার্স করা স্বত্বেও হেড দিদিমণি আমায় ফাইভ সিক্সের ক্লাস দেন।ইলেভেন টুয়েলভের ক্লাস তো দেনই না।
---বাহ! খুব ভালো দেবী।কোন চাপের কাছে নতিস্বীকার করবি না।
----- আর তোমার জন্য আমার কত গর্ব হয় জানো অভিদা!কোনো একদিন তুমি আমাকে বলেছিলে আমরা দুজনে একসঙ্গে মানুষের জন্যে কাজ করব।আমরা দুজনে ছিটকে গেছি দুদিকে।কিন্তু তুমি মানুষের জন্যে কত ভালো কাজ করছ।মানুষের কত কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছ তুমি।
নীচে থেকে অভীক চেঁচিয়ে ডাকল,"বাবা,মা তোমাকে নীচে ডাকছে।"
অভিরাজ উঠে পড়ল। দেবযানী পিছন ডেকে বলল,"আমাকে তোমার আদর্শ গ্রাম দেখাবে না অভিদা?আমি কালকের দিনটা আছি।পরশু ফিরতে হবে।"অভিরাজ কোন উত্তর না দিয়ে নীচে চলে গেল।
৩)
পরদিন ছিল রবিবার।প্রাতরাশের পর অভিরাজ স্কুটারে করে দেবযানীকে কান্দি গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজ দেখাতে নিয়ে বেরোলো।আহা,দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল দেবযানী।ঢেলে সাজিয়েছে বটে অভিদা!সততাই তার মূলধন।ছবির মতো সুন্দর গ্রাম।পাকা রাস্তা।রাস্তার দুধারে প্রচুর সবুজ গাছগাছালি।কান্দি কলেজ। দুটি হাই স্কুল।চারটে প্রাইমারী স্কুল।অগুন্তি অঙ্গনওয়ারী স্কুল।পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র।সব সাজানো গোছানো।দুই হাত দূরে দূরে ডীপ টিউবওয়েল।চাষের জমিতে শ্যালো মেশিন, ট্র্যাক্টর।সবুজ ফসলে ভরে আছে সজল দিগন্ত। একশো দিনের কর্মীরা কাজ করছে ক্ষেতে।খেলার মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলে।গ্রামের প্রতিটা কোণে অভিরাজের সযত্ন হাতের ছোঁয়া। সাধে কি সে জনগণের নয়নের মণি!দেবযানী উচ্ছ্বাস সংবরণ করে মনে মনে বলল,"মান গয়ে উস্তাদ"
সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়ার পর অভিরাজ দোতলায় উঠল।দেবযানীকে জিজ্ঞেস করল," তোর কেমন লাগল আমার কাজ?"
দেবযানী--- তুমি প্রকৃত পুরুষ অভিদা। যে এমন গড়তে পারে, তাকে তো মানুষ মনোনীত করবেই। এই গ্রামে তুমিই শেষ কথা।
কথা বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে ফেলল দেবযানী।হতভম্ব হয়ে অভিরাজ ওর দুই কাঁধে হাত দিয়ে বলল, "কাঁদছিস কেন,এই পাগলী?কি হয়েছে?"
দেবযানী-----"খুব ইচ্ছে করে তোমার কাজের শরিক হই। তুমি বলেছিলে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মানুষের কাজ করব।"
অভিরাজ আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না।দেবযানীর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে শুষে নিল তার নরম লাবণ্য। দেবযানীর কোমল বাম স্তন তুলে নিল নিজের দৃঢ় মুঠিতে। দেবযানী ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,"তোমার সব আছে অভিদা। তোমার পঞ্চায়েত,পরিবার,সন্তান সব আছে। আমার কিচ্ছু নেই,কেউ নেই। আমাকে একটা জিনিষ দেবে?"
বলিষ্ঠ আলিঙ্গনে দেবযানীকে বেঁধে ফেলে অভিরাজ অস্ফুটে বলল----"বল তোর কি চাই?"
দেবযানী বলল,"আমাকে অভীককে দাও। ও আমার কাছে থেকে যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে। আমার নিঃসঙ্গ জীবন ও ভরিয়ে তুলবে।"
অভিরাজ কোন উত্তর না দিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগল দেবযানীকে। দেবযানীর খুব ভালো লাগছিল। ও চাইছিল অভিরাজ ওর ডান স্তনও স্পর্শ করুক। তবু ও ক্লান্ত গলায় বলল,"ছাড়ো অভিদা।"অভিরাজ সঙ্গে সঙ্গে ওকে ছেড়ে দিল।
সোমবার ভোরবেলা কলকাতায় চলে যাচ্ছে দেবযানী আর অভীক। দেবযানী শক্ত করে ধরে আছে অভীকের হাত। দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে অভিরাজ আর সুনন্দা বারবার ফিরে ফিরে দেখছে অভীক আর দেবযানী।অভিরাজ,সুনন্দা,দেবযানী তিনজনেরই মুখ আজ ম্লান,মন বিষাদাচ্ছন্ন।কেবল আনন্দে উদ্দীপনায় ঝলমল করছে অভীকের মুখখানা
সমাপ্ত
© FB.com/keya.roy.980967