চারপাশটা কেমন গোলাপিটে মতো যেন । সন্ধেও নয়,আবার রাতও নয় । জমাট অন্ধকারেও আলোর আভা।হ্যারিকেন জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু এ আলো তার নয় । প্রকৃতিগত অপার্থিব এক রশ্মি চারদিকে । চোখদুটো খুলতে চাইছেন তীর্থঙ্কর । কিন্তু এতটাই অসম্ভব ভারী চোখের পাতাদুটো,পারছেন না । মিষ্টি একটা গন্ধ চেতনায় আঘাত করছে, ঠিক কোন ফুলের মনে পরছেনা ।
..বলি ও বাপু,আর কতক্ষণ বোবা সেজে বসে থাকব শুনি?
আহ্!কি মিষ্টি গলা!ঠিক যেন কেউ হাত বুলিয়ে দিল তীর্থঙ্করের কাঁচা পাকা চুলে ঢাকা মাথায়।চোখ মেললেন তীর্থঙ্কর । মাথার কাছে বসে আছে মেয়েটা । গোলাপি রঙের বেনারসি, সোনালী জরির কাজ।কোঁকড়ানো এলো চুল।নিরাভরণ শরীর । মুখটা কি তীক্ষ্ণ অথচ স্নিগ্ধ । কতই আর বয়স হবে?বড় নাতনিটার বয়সী হবে।মুখটা খুব চেনা । কোথায় দেখেছে?
..আর কত ঘুমুবে গো?কখন থেকে বসে আছি,দুটো কতা কইবার জন্য।
..হ্যাঁ হ্যাঁ, বল মা ।
শুয়েই বললেন তীর্থঙ্কর।
..খুব ব্যস্ত বুজি?
..তা একটু মা । সামনেই পুজো কিনা । সব দায়িত্ব নিজের কাঁধেই নি এখনও।
..জানি তো।সেই কোনকালের পুজো তোমাদের বাড়ির । সবাই জানে । কত দূর থেকে লোক আসে।
..তা বটে।
..জাঁকজমক কি কম?খুব নিষ্ঠা ভরে কর বটে ।
..সবই মায়ের কৃপা ।
..তা হ্যাঁগা,বলি হত শুনেছি আগে!
..হ্যাঁ মা।হত আগে।এখন আর....মানে ওই কুমড়ো, লাউ এসব বলি হয় আর কি । প্রাণীহত্যা করিনা আর।মা নেননা।
..সেই সেই।
তখনও ভেবে চলেছেন তীর্থঙ্কর, খুব চেনা মুখটা।
..আচ্ছা মা,একটা কথা ছিল । কোথায় এসেছ এখানে?মানে কার বাড়িতে উঠেছ?
..পুজো দেকতে এয়েচি গো ।
..ও।
..খুব ক্ষিদে লেগেচে বুয়েচ?যাই।
..সে কি মা?ক্ষিদে পেয়েছে তো বস একটু । আমি ভেতর বাড়িতে খবর পাঠাচ্ছি।খাবার দিয়ে যাবে।
..না গো । যাই । আমি যা খাই তোমাদের তা নেই ঘরে।
..কি এমন খাও তুমি?
..তোমরা যা খাও তা খাইনা । তোমরা তো কেবল ওই কুমড়ো লাউ ফলমূল.....
..ধুস্।কে বললে এসব?
হো হো করে হেসে উঠলেন তীর্থঙ্কর।
..তুমিই তো বললে গা!প্রাণীহত্যা হয়না আর।
..আরে সে তো দুগ্গাপুজোয়,বলির কথা বললাম।
অদ্ভুত হাসল মেয়েটা । স্মৃতি ঘেঁষে চলে গেল,কোথায় দেখেছেন মুখটা?খুব চেনা।
..হাসছ যে?
হেসেই যাচ্ছে মেয়েটা । দমকে দমকে উঠছে শরীরটা । গন্ধটা আরও তীব্র।
..বলি বাছা,প্রাণীহত্যা শুধু দেবীর বেলাতেই পাপ?পাঁঠা দেবীর পায়ে বলি গেলেই দোষ?তোমরা কি বাছা,মরা পাঁঠা খাও?নাকি ঈশ্বরেই পাপ লাগে?তোমাদের লাগেনা?
হেসে লুটিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা । উফ্!এত হাসি আসে কোথা থেকে?
..দাদু?ও দাদু?
ধড়মড় করে উঠে বসলেন তীর্থঙ্কর । ঘামে শরীর সপসপ করছে।
..মা বলল ভেতরে চল । ঠাকুরদালানে ঘুমোচ্ছ কেন?
ছোট নাতনির দিকে বোকার মতো তাকালেন তীর্থঙ্কর।হ্যারিকেন জ্বলছে।মায়ের সাজসজ্জা শেষের দিকে।সেই দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পরেছিলেন।
..চল।
উঠলেন তীর্থঙ্কর।চশমাটা চোখে দিয়ে দাঁড়াতেই মায়ের মুখটা চোখের সামনে । সেই গোলাপি শাড়ি,খোলা চুল।
হাউহাউ কেঁদে মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরলেন তীর্থঙ্কর । পা দুটো ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে।।
সমাপ্ত
© FB.com/sritama.sengupta.378