সালটা ছিয়াশি কি সাতাশি, মানে এই ধরুন প্রায় বছর তিরিশ আগে! পারমিতার বয়স তখন মাত্র সাত, শহরের একটা নামী স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে ও । নতুন বই খাতা, নতুন পেন্সিল বক্স, নতুন মিস, নতুন বন্ধু বান্ধবী। এদের সবার সাথে পারমিতা মিশে গিয়েছিলো ধীরে ধীরে, হয়ে উঠেছিল ওদেরই একজন। তবুও দুপুরে, লাঞ্চের সময় পারমিতা অন্যদের কাছে সঙ্কোচ বোধ করতো।
ওর বাবা ওকে কোনোদিন মুড়ি আর আলুভাজা ছাড়া কিছু দিতে পারতো না। সেখানে অন্যরা কেউ লুচি-আলুর দম, কেউ বা ম্যাগি , কেউ বা স্যান্ডউইচ নিয়ে আসতো । যখনই ক্লাসে মা-বাবাকে নিয়ে কিছু বলতে বলা হত, পারমিতা পারতো না কিছু বলতে। ছোট্ট প্রাণটা তো জানতোই না, মা কাকে বলে ! মা ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলো। ও শুধু জানতো, ওর মা, কোনো এক অজানা কারণবশত, ওর সাথে থাকে না, থাকে ভগবানের কাছে, ওই রাতের আকাশের তারা হয়ে মিটমিট করে দেখে ওকে। আর পারমিতার বাবা? ওর বাবা ওই স্কুলেই লাইব্রেরিতে কাজ করতো।
পারমিতাকে স্কুলে নেওয়ার সময়েও অনেকেই মেনে নিতে পারে নি । স্কুলের প্রিন্সিপাল, নিজের দায়িত্বে, সবার বিরুদ্ধে গিয়ে পারমিতাকে ভর্তি করিয়েছিলেন স্কুলে। সেজন্য অনেকেই পারমিতাকে সহ্য করতে পারতো না, যদিও প্রকাশ্যে কিছু বলতেও পারতো না। ও যে অন্য অনেকের থেকে পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। অন্যদের যেটা বুঝতে দুই থেকে তিনদিন সময় লেগে যেত, সেটাই হয়তো পারমিতা ঘন্টাখানেকের মধ্যে বুঝে যেত !
কেটে গেলো প্রায় মাস ছয় ! সেদিন ছিল পারমিতাদের ক্লাস টেস্ট। কিছু নম্বর লেখা, কিছু অক্ষর চেনা - এইসব আর কি। যখন টেস্ট প্রায় শেষের দিকে, হঠাৎ কয়েকজন সহপাঠী, চেঁচিয়ে উঠলো, "মিস , পারমিতা চুরি করে লিখছে। ও চোর। আমরা দেখেছি , পারমিতা নিচু হয়ে ডেস্কের মধ্যে কিছু করছে আর লিখছে ।"
ক্লাস টিচার ছুটে এলেন, "কি হয়েছে? পারমিতা কি করছো ? দেখি? কোথায় চিরকুটটা ? কি দেখে লিখেছিলে?"
পারমিতা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে ," না, আমি কিছু করিনি, বিশ্বাস করুন আমি কিছু করিনি। ডেস্কের মধ্যে তো আমার পেন্সিল বক্স, আমি পেন্সিল কাটার কলটা খুঁজছিলাম। "
মিস জোরে চেঁচিয়ে ওঠেন , " চো ও প ! একদম মিথ্যে কথা বলবে না ! তখনই দিদিকে বলেছিলাম তোমাকে যেন না নেওয়া হয় ! কাকে না কাকে এডমিশন দিয়ে দিয়েছে। এরকম ই তো হবে ! "
চিৎকার চেঁচামিচি শুনে আসে পাশের ক্লাস থেকে কয়েকজন টিচার চলে আসে দেখতে ! এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা পারমিতার এডমিশনে খুশি ছিলেন না , তারাও সুযোগ পেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ,"মিথ্যে কথা বলছো তুমি ! এতজন দেখেছে , আর তুমি না বলছো ? এই টুকু বয়সেই এতো ? কোথায় তোমার পেন্সিল বক্স , দেখি?"
আরেকজন বলে উঠলেন ,"হবেই তো, মা তো আগেই গেছে, বাপ টাও স্কুলের একটা সাধারন লাইব্রেরি এসিস্টেন্ট, তার মেয়ের তো এরকমই হওয়া উচিত, সে চোর হবে না তো আর কে হবে?"
সেদিন পারমিতা খুব কেঁদেছিলো ,কান্না ছাড়া আর কোনো প্রতিবাদের ভাষা তার জানা ছিল না। সারা ক্লাস, সব বন্ধুদের সামনে সে লজ্জায়-ঘৃনায়-কষ্টে কুঁকড়ে যাচ্ছিলো সেদিন। শেষ পর্যন্ত সবার তর্জন গর্জনে, ভয়ে ভয়ে পারমিতা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল,ও চুরি করে লিখছিলো ।
ক্লাসের কয়েকজন সহপাঠীদের মুখে আড়চোখে দেখেছিলো হাসির রেখা ছিল সেদিন পারমিতা !
আজ এতো বছর হয়ে গেছে, আজও পারমিতা মাঝে মাঝেই একা একা ঘরের কোণে বসে থাকে। কিরকম যেন হারিয়ে যায় সেই দিনগুলোতে ; ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে দেওয়ালের দিকে আর মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে,
"আমি চোর নই, আমি চুরি করিনি।"
না না সব ভুল !
"আমিই তো চোর , আমি ছাড়া আর কি কেউ চুরি করতে পারে "?
"হা হা হা হা....."
কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে পারমিতা!!!
সমাপ্ত
© FB.com/jayanta.adhikari