শ্রী প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে রয়েছে আজ সকাল থেকে। আজ জিনিসটার ডেলিভারি পাবে। অনেক, অনেক দিন ধরে লেগে থেকে, অনেক কষ্ট করে অনেক টাকা খরচ করে তবে জিনিসটা পেতে চলেছে। বাবা জানতে পারলে খুশি হবেন না। শ্রী যে এভাবে দেদার টাকা পয়সা খরচ করে তাতে ওনার কোনো আপত্তি নেই। সেটা অবশ্য এই জন্য নয় যে শ্রীর বাবা বৃষভানু গোকুলের শুধু নন, সমস্ত উত্তরপ্রদেশের একজন ধনীতম ব্যবসায়ী। পয়সার অভাব ওনার নেই, সেই সঙ্গে ছেলে মেয়ের প্রতি স্নেহেরও অভাব নেই। তবে সেই স্নেহে তিনি অন্ধ নন আর ছেলে মেয়েও বাবা অন্ত প্রাণ। বাবাকে ভালোবাসেও যেমন তেমনই তার বিশ্বাসের মর্যাদাও দেয়। সুতরাং আদরের কন্যা শ্রীমতি যে অকারণ টাকা অপচয় করবে না বা অসৎ কাজে ব্যয় করবে না, তা তিনি জানেন। বস্তুত পারিবারিক নিয়ম মেনে শ্রীমতিকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে তিনি মরমে মরে আছেন। সেই বিয়ে সুখের হলে কিছু বলার ছিল না। কিন্তু আয়ানের মত একজন বয়স্ক আর অনুভূতিশূণ্য মানুষকে নিয়ে শ্রীমতির মত সুন্দরী গুনবতী রুচিশীলা আধুনিকা মেয়ে কি করে ঘর করে! তাই সে পাট চুকিয়ে দিয়ে শ্রীকে তিনি নিজের কাছে রেখেছেন। শ্রী নিজের মত করে জীবন যাপন করুক এবার, এই তাঁর ইচ্ছে। শ্রীও এখন ভালোই আছে। প্রচুর বন্ধু তার, তাদের সাথে আড্ডা, সিনেমা, যমুনায় জলবিহার, এসব নিয়ে মেতে আছে দিব্যি। তার মধ্যে বিশাখা ললিতার মত প্রাণের বন্ধু পেয়ে সে আর কোনো কিছুরই অভাব বোধ করছে না। কিন্তু বয়সের তো একটা ধর্ম আছে। পূর্ণ যৌবনবতী, অসামান্য রূপসী আর ধনীর দুলালী শ্রীমতির চারপাশে তাই দিবারাত্রি অসংখ্য ভ্রমরগুঞ্জণ। শ্রীর যে খারাপ লাগে তা নয়, কিন্তু কোনোরকম সম্পর্কে জড়িয়ে সে আর ঠকতে রাজী নয়। নিজের অমতে হোক্, বাবা আর পরিবারের মান রাখতে সে বিয়ে তো করেছিল। ঘরকন্না করার চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু বয়সে অনেক বড় স্বামীর উদাসীনতা আর দজ্জাল শাশুড়ি ননদীর গঞ্জনা নিয়ে সংসারে সে বেশি দিন টিকতে পারলো কই। কপাল ভালো তার, বাবা তাকে দ্বিতীয়বার জীবন শুরু করার সুযোগ দিয়েছেন। গোকুলের সমাজ বা তাদের পরিবার পরিজন প্রথমদিকে অনেক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বৃষভানুর প্রভাব প্রতিপত্তিতে সেসব নিয়ে বেশি জলঘোলা করার সাহস হয়নি কারুর। এখন গোকুলের তরুণ সমাজে শ্রীমতির যা কদর তা নিয়ে লোকে ঠারেঠোরে অনেক কথা বলে বটে, তবে শ্রী আর সেসব গ্রাহ্য করে না। গোকুলের রমণীকূলে সে পরমশ্রেষ্ঠা একজন- সেটা শ্রী শুধু যে জানে তা নয়, সেটা নিয়ে সে খুব কনশাস্ও।
বেশ চলছিল জীবন। এর মধ্যে হাজির ঐ কালোকেলে ছেলেটা। মথুরার বিখ্যাত কোন রাজপরিবারের নাকি মেয়ের ঘরের ছেলে। থাকে অবশ্য জন্ম থেকেই গোকুলে। বিরাট ডেয়ারি ফার্মের মালিক নিঃসন্তান নন্দদেবের অ্যাডপ্টেড্ ছেলে। লোকে তো বলে তার মামা নাকি একেবারে নরাধম, নিজের বোন আর তার স্বামীকে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে যাবজ্জীবন জেলের ঘানি টানানোর ব্যবস্থা করেছেন। এত সব গল্পের সত্যি মিথ্যে নিয়ে শ্রীর মোটেই মাথা ব্যথা নেই। সে মজেছে ঐ কালো ছেলেটির চোখে আর তার হাতের জাদুতে। কি অসাধারণ ফ্লুটই না বাজায় সে। গোকুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক উতসবে প্রথম শোনে শ্রী সেই বাঁশি। তারপর থেকে তার ঘুম ছুটেছে। আর কপালও তেমন, মনটা অন্য দিকে ঘোরাবার জন্য যখন যে কাজে যেদিকে যাচ্ছে, সেখানেই সে ব্যাটা হাজির। ক্লাবে গিয়ে দেখে কালীয়-কিলিং এর মত দুর্ধর্ষ গেমেও সে জিতে বসে আছে। যমুনার পাড়ে সন্ধ্যাবেলা হাওয়া খেতে গিয়ে দেখে দলবল নিয়ে সেও হাজির। আর বন্ধুরা যেন একেবারে মাথায় তুলে রাখে গুনধরটিকে। গুনের নাকি কমতি নেই তার। গত বর্ষায় তার বাবার ডেয়ারি ফার্ম ভেসে যাওয়ার জোগাড় হয়ে ছিল। সেই ছেলে তখন কি এক গোবর্ধন-শেড তৈরি করে রাতারাতি সামাল দেয়। তাই দেখতে আবার লোকের ভীড় লেগে গিয়েছিল বলে! ওদিকে আবার বান্ধবীরও কমতি নেই তার। সর্বক্ষণই চারপাশে একগাদা সুন্দরী গুনগুন করছে। সবারই সে অতি প্রিয় যেন! শ্রীর বুকের ভেতর কেমন যেন একটা বাষ্প জমতে থাকে! এ কি ঈর্ষা না অভিমান! ঐ কালোমানিকের চোখমুখ দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই যে ঐ সুন্দরীমহলে তার স্পেশাল পছন্দের কেউ আছে কিনা।
ললিতা বিশাখার নজর এড়ায়নি ব্যপারটা। তারা বলে, মরেছিস নাকি? হি হি করে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। শ্রীমতির গোঁসা বাড়ে। কদিন বেরনোই বন্ধ করে দেয় বাড়ি থেকে। একদিন সন্ধ্যার আঁধার বেশ ঘনালে ছাদে পায়চারি সেরে নামবে নামবে করছিল, হটাৎ শোনে সেই বাঁশি। চমকে পড়েই যাচ্ছিল প্রায়, ভালো করে চেয়ে দেখে পিছনে বিশাখার কাকার বাড়ির ছাদে সেই মক্কেল! করেছে কি বিশাখাটা! আসুক আজ! দুদ্দাড় করে নীচে পালায় শ্রী। পিছন থেকে ভারি জোর গলায় হা হা হাসি ভেসে আসে।
বিশাখা একা আসার সাহস পায়নি। ললিতাকে নিয়েই হাজির। দুই সখী মিলে অনেক বোঝায়। সেও নাকি মন দিয়ে বসে আছে। শ্রী তেড়েমেড়ে ওঠে- যা যা, তার মন দেওয়ার লোকের অভাব নাকি! পুরো গোকুলের মেয়ের দল সাথে নিয়ে ঘুরছে সর্বক্ষণ!
ওরে না রে - ললিতা কঁকিয়ে ওঠে। ওরাই ঘোরে ওর পেছনে। বেচারা কারুর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারে না, জানিস! সবাই ওর বন্ধু। মানে .....
শ্রীর রোষকষায়িত চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায় ললিতা।
প্রমাণ কি?
প্র প্র প্রমান মানে? কিসের প্রমান?
ও যে আর কারুর ইয়ে .... মানে, ও যে মনটা আমাকেই দিয়েছে, আর কাউকে দেয়নি, কি প্রমান?
ওমা! এর আবার প্রমাণ কি? এ আবার প্রমাণ করা যায় নাকি? একি ল্যাবরেটরির টেস্টে ধরা পড়ে নাকি মাইক্রোস্কোপে? যুগে যুগে প্রেমিক প্রেমিকারা এরকমই মন দিয়ে বসে থাকে। একে অন্যেই শুধু বোঝে সেটা! সেই রাধা-কৃষ্ণের আমল থেকে শুরু করে হীর-রণ্ঝা বল লায়লা মজনু বল আর রাজ-সিমরণ! কে কাকে কবে প্রমাণ দিয়েছে?
না, সেসব আমি জানি না। আমার প্রমান চাই। আমি আসল সত্য জেনে, আসল রূপ চিনে তবে এগোবো। এখন তোরাই খুঁজে বার কর চিনে নেবার উপায় কি! নয়ত সেই তাকেই বল, সে নাকি সব কাজে পারদর্শী? সেই বলুক কিভাবে নিজেকে চেনাবে! কিভাবে আমি তাকে চিনে নেবো!
মুখ চুন করে বিশাখা ললিতা কেটে পড়ে। এসব তাকে বলা যায় নাকি। হ্যাঁ, অনেক অসাধ্য সাধনই নাকি সে করতে পারে বলে শুনেছে তারা। তাবলে কি বলা যায়, তোমায় কি দিয়ে যায় চেনা?
ধুর ধুর, উপায় খুজতে দুজনে সেই অগতির গতি গুগুল খুলে বসে। সার্চ দেয় চিনে নেবার উপায়। ওমা! এতো সাংঘাতিক ব্যাপার। শ্রী সত্যিই বুদ্ধিমতী মেয়ে তো! সত্যিই চিনে নেবার উপায় আছে। মানে উপায় আবিষ্কার হয়েছিল একসময়। একদম সাধারন, খুব সাধারণ একটা মাত্র জিনিস দিয়েই প্রেমিক প্রেমিকারা চিনে নিতে পারত একে অন্যকে। কিন্তু সেই জিনিসটাই তো অবসোলেট হতে বসেছে। এত পরিমানে ব্যবহার হয়েছিল সারা পৃথিবী জুড়ে যে কয়েক বছরের মধ্যেই এর যোগান ফুরিয়ে যায়। তারপর সব কাজ ফেলে শুধুমাত্র চিনে নেওয়াতেই মানুষ এত মজে গেছিল যে সব দেশের সরকার একসময় ঐসব চেনাচিনি বন্ধ করে দেয় আইন করে। এখন শুধু মাত্র চোরা কারবারিদের কাছেই সেটি পাওয়া যায়, তাও শুধু সিঙ্গাপুরে। তাহলে ললিতা বিশাখা কি করে সেটা যোগাড় করবে? দুজনে শলা পরামর্শ করে। তারপর ফোন করে কানুদা নামে কালই সেভ করা নাম্বারটায়। জানায়, ঐ বস্তুটি যদি গিফট্ করতে পারো তো শ্রীমতির মন পাবে।
ফিক্ করে হেসে উঠলো ঐ প্রান্ত। চিনতে চাইছে তো? তাই হবে। কোন ঠিকানায় পাঠাবো বলো?
সেই জিনিসটাই আজ হাতে পাবে শ্রী।না, ললিতা বিশাখার শত অনুরোধেও গিফট্ নিতে সে রাজী হয়নি। নগদ মূল্য সে চুকিয়ে দেবে। উফ্, ছবিই দেখেছে শুধু এতকাল। ছোটবেলায় মা কলাবতীর মুখে শুনেও ছিল একবার। সে হওয়ার আগে মা নাকি চেয়ে ছিলেন বাবার কাছে। বাবা কিছুতেই ঐ বেআইনি জিনিসটা বাড়িতে আনতে চাননি। তখন এত দুষ্প্রাপ্য ছিল না, ভালো পয়সা দিলে কালোবাজারে মিলত। কিন্তু কারুর কাছে পাওয়া গেলেই আজীবন হাজতবাস নিশ্চিত। ব্যবসায়ী বৃষভানুর শত্রুর তো অভাব নেই। তিনি তাই রিস্ক নিতে রাজী হননি। আজ তাই আদরের শ্রী যে এই কাজটা করলো, জানলে তিনি দুঃখ পাবেন। কিন্তু শ্রীর উপায় নেই, কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে সে। এই সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করেই হয়ত টিঁকে থাকবে অমর এক প্রেমলীলা।
কলিং বেলের আওয়াজে শ্রীর পা যেন পাথর হয়ে গেছে। ললিতাই নিয়ে এলো ডেলিভারি বয়ের কাছ থেকে। প্যাকিং খুলে বেরলো দামী নরম লাল টুকটুকে ভেলভেট কাপড়ের বাক্স। অপূর্ব কারুকাজ করা সোনার ক্লিপ খুলে শ্রী খুব ধীরে ধীরে খুলল সেই বাক্স। আহ্, ভিতরে উজ্জ্বল হলুদ নরম মসলিনে তিনটে সারিতে সুন্দর করে সাজানো ছটি চিনেবাদাম। প্রেম চিনে নেবার বাদাম। খাঁটি প্রেম চিনিয়ে দিয়ে এই বাদাম বহু প্রেমিক প্রেমিকার জীবন গড়েছে। তাই তো এ চিনে-বাদাম। এই বাদাম ভেঙে ভেঙে খেয়ে, খাইয়ে একে অপরকে চিনে নিতে এক সময় ময়দান নামে এক জায়গায় লাইন পড়ে যেত। তারপর গড়ে ওঠে অনেক লাভ-কর্নার। সেখানেই শুধু মিলত এই মহার্ঘ্য বস্তুটি। ধীরে ধীরে আকাশ ছোঁয়া দাম হয় এর। বিদেশীরাও আসতে শুরু করলো এদেশে শুধু মাত্র চিনেবাদাম দিয়ে প্রেম চিনে নিতে। তারপর যথারীতি শুরু হয় কালোবাজারি। একসময় হুম্বাইতে ডন বারুদের হাতে চলে যায় সব চিনেবাদাম। বারুদের রাইভালের হাত ধরে জিতে এসে যেবার এই নতুন সরকার গড়লো, সেবারই এই চিনেবাদামকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে দেওয়া হলো। তাতে অবশ্য বারুদের লাভই হলো, কারণ লুকিয়ে চুরিয়ে চিনে নেওয়া চলতেই লাগলো। সিঙ্গাপুরকে বেস করে ডার্ক ওয়ার্ল্ডে দিব্যি চলছে এর ব্যবসা। সেই ওয়ার্ল্ড থেকেই শ্রীমতির হাতে পৌছেছে এই মহার্ঘ্য বস্তু। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা বাদাম তুলে নিতেই বেরিয়ে এলো একটুকরো কাগজ। খুলে নিয়ে দেখে লেখা আছে - আমাকে চিনে (নে)বা(র)দাম দিতে হবে কিন্তু। আজ সন্ধ্যায় যমুনাপুলিনে।
সমাপ্ত
© FB.com/suutapa