Briddhasrom - A bengali story

Jolchobi

বৃদ্ধাশ্রম

জয়ন্ত অধিকারী

-মা, এটা তুমি কি বলছো ? আমি আছি, রিনি আছে, আমরা থাকতে তুমি কেন হঠাৎ এরকম কথা ভাবছো ? আমরা কি তোমার পর ?
বিস্মিত হয়ে প্রদীপ বলে ওঠে ; পাশে বসে আছে বোন রিনি। জয়া বিছানায় বসে, প্রদীপের মেয়ে জ্যোতি আর রিনির আট মাসের ছেলে রাজীবকে কোলে নিয়ে। ওদের সাথে খেলতে খেলতে জয়া মুখ তুলে তাকালো ছেলে আর মেয়ের দিকে।

এই তো কয়েকদিন আগের কথা , নাকি কয়েক যুগ হয়ে গেলো ? প্রদীপ সবে হামা দিতে শুরু করেছে ; রিনি সারা ঘরে নুপুরের রিনিঝিনি তুলে ছুটে বেড়াচ্ছে ; প্রদীপ এই হঠাৎ করে সঞ্জীবের পিঠে ওঠে পড়লো বাবাকে ঘোড়া বানিয়ে; ওদিকে রিনির আবার বিকেলে বাবার সাথে ব্যাডমিন্টন খেলার চেষ্টা ; প্রথমদিন স্কুলে যেতে গিয়ে প্রদীপের সেকি কান্না ; ওদিকে রিনি দুদিকে ঝুঁটি বেঁধে গাছে উঠে পড়েছে ফুল পাড়তে ; একদিন খেলার মাঠ থেকে প্রদীপকে নিয়ে সোজা হসপিটালে-পা ভেঙে গিয়েছিলো ; আবার অন্যদিকে রিনি, নাচের কম্পিটিশনে হেরে গিয়ে মন খারাপ করে দুদিন না খেয়ে চুপ করে বসে থাকা ; কত স্মৃতি, চোখের সামনে ভেসে আসছে আজ। সঞ্জীব হঠাৎ করে চলে গেলো , প্রায় সপ্তাহখানেক হয়েছে।

বেশ ছিল মানুষটা , কোনো রোগ বলতে সেরকম কিছু ছিল না ; বেশ হাঁটতো , ঘুরে বেড়াতো , একসাথে দুজনে মিলে ঘুরতে যেতাম আমরা দুজনে বিকেলে, সন্ধেতে ; সেদিন হঠাৎ করে কি যে হোলো, বাড়িতে এসেই বললো শরীর খারাপ লাগছে, ঠান্ডা,কাশি, হঠাৎ করে বুকে ব্যথা ; হজমের সমস্যা ভেবে কিছু ওষুধ নিয়ে শুয়ে পড়লো কিছু না খেয়ে রাতে ! সকালে উঠে জয়া দেখে মানুষটা অদ্ভুতভাবে শুয়ে আছে , মুখে হাসি , কি প্রশান্তি মুখে ! ডাকতে যায় সঞ্জীবকে , বুঝতে পারে ও আর নেই ! সঞ্জীব চলে গেছে সেই দেশে যেখান থেকে কেউ কোনোদিন ফিরে আসে না ! কত বছর বয়স হয়েছিলো সঞ্জীবের ? মাত্র একাত্তর ? ডাক্তার এসে পরে জানালো ঘুমের মধ্যেই হঠাৎ করে ম্যাসিভ হার্ট এটাক ! কিছু বোঝার আগেই, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওর মৃত্যু !

জয়ার তখন তেইশ, সঞ্জীবের ছাব্বিশ, তখন থেকে একসাথে পথ চলা শুরু দুজনের। একসাথে থাকতে থাকতে , কবে থেকে যে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো দুজন দুজনের। ছেলে মেয়েরা বড়ো হয়ে খুঁজে পেলো নিজেদের নতুন ঠিকানা ; কাজ নিয়ে একজন চলে গেলো দেশের অন্য এক প্রান্তে, আরেকজন পাড়ি দিলো সাত সমুদ্রের পারে ! সময়ের সাথে সাথে ওদেরও প্রেম ভালোবাসা হলো, নিজেদের পছন্দের জীবনসঙ্গীকে সাথে নিয়ে, ওরাও আজ নিজেদের জগৎ নিয়ে ব্যস্ত !

প্রদীপ আর রিনি যে যার জগতে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার পরে, সঞ্জীব আর জয়া আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ে একে অপরের প্রতি। দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতেই পারে না , একসাথে বিছানা ছেড়ে সকালে ঘুম থেকে ওঠা, একসাথে চায়ের কাপ এ চুমুক, একসাথে বাজারে বেরোনো, ঘুরতে যাওয়া , কারোর কিছু হলে, সামান্য মাথা ব্যথা হলেও অন্যজনের চিন্তা বা দুশ্চিন্তা ! যত বয়স বাড়তে থাকলো, মৃত্যুচিন্তাও আসতে থাকে মনের ভেতরে দুজনেরই। একসাথে থাকলেও, একসাথে তো যাওয়া হবে না , কোনো একজন আগে যাবেই, আরেকজনকে একা করে দিয়ে। তা জেনেও একসাথে, হাতে হাত দিয়ে হেঁটে চলা , সেই অনির্দিষ্ট সত্যের দিকে , সেই অমোঘ নিয়তির দিকে। তবে এতো তাড়াতাড়ি যে সেই দিনটা চলে আসবে, সেটা জয়া কল্পনাও করতে পারে নি।

বাবা হিসেবে সঞ্জীব বেশ হিসেবি মানুষ ছিল, তাই আগে থেকেই উইল করে রেখে গিয়েছিলো ! ওর অনুপস্থিতিতে কারোর কোনো অসুবিধেই হয় নি কাগজপত্র নিয়ে। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পরে মা এখন হঠাৎ করেই বলে বসেছে মা কারোর সাথে থাকবে না ! মা সব কিছু বিক্রি করে দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাবে। সেটাকে প্রদীপ বা রিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।

জয়া রাজীবকে কোলের মধ্যে দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলে উঠলো ছেলে আর মেয়ের উদ্দেশ্যে ; "দেখ , আমি কাউকে কোনো অসুবিধেতে ফেলতে চাই না , তাই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। "

প্রদীপ বলে ওঠে ," কিসের অসুবিধে মা ? তুমি আমাদের সাথে থাকলে, আমাদের অসুবিধে হবে , একথা কেন বলছো ? "

অন্যদিকে রিনিও বলে ,"দাদা তো ঠিকই বলছে মা ! তুমি কয়েকদিন দাদার সাথে, কয়েকদিন আমাদের সাথে থাকবে , এভাবেই দিব্যি চলে যাবে হেসে খেলে। আমরাও নিশ্চিন্ত , আমাদের বাচ্ছাগুলোও তাদের ঠাম্মাকে পাবে সাথে ! "

" একদম ঠিক বলেছিস বোন , মা যে কি সব উল্টোপাল্টা কথা বলছে ! "

জয়া হেসে ফেললো, " ওরে শোন , এসব কথা বলতে খুব ভালো লাগে , বুঝলি ! আমি আমার এতো বছরের অভিজ্ঞতা দিয়েই বলছি, এরকম হয় না , হবে না ! আমার যখন আরো বয়স বাড়বে, আমার কানে শুনতে পাবো না, চোখের জোর কমে আসবে, তখন তোদেরই মনে হবে আমাকে একটা বার্ডেন ! আবার বয়স বাড়লে বুড়ো বুড়িরা বাচ্চাদের মতোই হয়ে যায় , হাজারো বায়না ! তখন তোরাই রেগে যাবি ! তোরা হয়তো কোথাও যেতে চাইছিস, আমাকে ফেলেও যেতে পারবি না। তোদের নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হবে তখন। তারপর আমরা পুরোনো দিনের মানুষ, তোদের মতো করে সবার সাথে মিশতে পারবো না , সবার সাথে কথা বলতে পারবো না ভালো করে ! তখন তোরা লজ্জায় পড়ে যেতে পারিস আমার জন্য অন্যদের সামনে। তারপর আরো বয়স হয়ে গেলে, যখন নড়তে চড়তে পারবো না , হয়তো আমি এক জায়গাতে বসে বসেই শাড়ি , জামা কাপড় সব নোংরা করে দেবো , পেচ্ছাপ - পায়খানা হয়ে যাবে, হয়তো বমি করে দেব বা আরো অনেককিছু হতে পারে। সেগুলো তোদের ভালো লাগবে না, আমারও খুব কষ্ট হবে। হয়তো রাগের বশে, তোরাই আমার গায়ে হাত তুলবি। এসব দিন আমি সত্যি দেখতে চাই না ! "

দুই ভালো বোন সমস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে, " মা , এসব কি বলছো , আমরা এরকম করবো ? তোমার সাথে? তুমি আমাদেরকে নিয়ে এরকম ভাবো ? "

জয়া উঠে এসে ওদের মাঝে দাঁড়িয়ে, এক হাত প্রদীপের মাথার ওপরে অরে হাত রিনির মাথায় রেখে বলে ওঠে ,"আমি জানি, তোরা আমার আর তোদের বাবার খুব ভালো সন্তান ; তোরা খুব ভালো শিক্ষা পেয়েছিস , তোরা এরকম কিছুই করবি না, করতে পারবি না ! কিন্তু আমি এই অবস্থায় তোদের সাথে থাকলে, অনেক রকম অসুবিধে হবে রে ! তোরা এখ্খন আবেগের বশে এইসব কথা বলছিস, তোদের বয়সটাও তো বাড়ছে ; তোদের দায়িত্ব, তোদের কাজের পরিসর আরো বাড়বে ধীরে ধীরে ! তখন সত্যিই তোরা এই বুড়ি মা কে নিয়ে অসহায় হয়ে যাবি ! আমাকে নিয়ে এতো ব্যস্ত হয়ে পড়বি, হয়তো তোদের অনেক কাজ আটকে যাবে ! তার থেকে এই ভালো, আমি বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাই ! ওখানে দেখ, আমি আমার বয়সের আরো অনেক মানুষ খুঁজে পাবো, ওদের মধ্যে আবার নতুন বন্ধুদের খুঁজে পাবো ! তারপর যারা বৃদ্ধাশ্রম চালায়, তাদের তত্ত্বাবধানে থাকবো আমি , তাই একা ঘরে মরে পড়ে থাকার মতো কিছু কখনো হবে না ! কিছু হলেই ওরা তোদেরকে যোগাযোগ করবে ; এছাড়া ওদের ডাক্তার আছে নিজস্ব , ওদের বিভিন্ন রকম কার্যকলাপ হয় আমাদের বয়সের বুড়ো বুড়িদের নিয়ে। তোদের সাথে গেলে আমি তো একা হয়ে যাবো রে ! সব বয়সের লোকজন, তাদের বয়সের লোকজনকেই তো আসে পাশে চায় , তাই না ? তাই বলছি , ভাবিস না আমাকে নিয়ে। তোরা আরো বড়ো হ, উন্নতি কর , আগে এগিয়ে যা ! আমি তোদের সাথে থাকলে, তোদেরকে পেছনে টেনে ধরে থাকবো ! আর মাঝে মাঝে তো আমি যাবো তোদের সাথে, তোদের সাথে গিয়ে থাকবো , নাতি নাতনির সাথে খেলবো ! সেটা আমি ছাড়বো না ! ধরে নে বৃদ্ধাশ্রম আমার নতুন ঘর, আর গরমের ছুটিতে, বা শীতের ছুটিতে আমি কখনো আমার ছেলের বাড়ি, কখনো মেয়ের বাড়িতে যাবো ! "

প্রদীপ আর রিনি দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে ধীরে ধীরে ,"কি আর বলি বলো, তোমায় ! তুমি তো সব ঠিক করেই নিয়েছো। কিন্তু এখনও আমরা বলছি, তুমি আমাদের সাথে থাকলে আমাদের কোনো অসুবিধে হতো না, মা !"

জয়া ওদেরকে ছেড়ে খোলা জানলার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে ওঠে , " আমি জানি রে , আমি জানি। "
মনে মনে বলে জয়া , তবুও একটা ভয় থেকেই যায় রে , তোরা এখন বুঝবি না ! আমার মতো বয়সে এলে হয়তো বুঝবি ! যে সন্তানদের আমি আর তোদের বাবা, রক্ত, সময়, ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করে তুলেছি ,এই বয়সে তাদের কাছে অপমানিত হতে চাই না !

প্রদীপ আর রিনি একটু পরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো
জয়া , গতকালের পেপারটা খোলা আছে এখনো টেবিলের ওপরে ;

ছেলের হাতে বাবা প্রহৃত......
মেয়ে আর জামাই দুজনে মিলে মাকে খুন করতে গিয়েছিলো জমির জন্য..........
ছেলে আর ছেলের বৌ ঘুরতে গেছে বাইরে এক সপ্তাহের জন্য, বয়স্ক মা ঘরে বন্ধ.......
একাকিত্ব সহ্য করতে না পেরে সত্তরোর্ধ বয়স্ক পিতা বহুতলের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন......

সমাপ্ত

© FB.com/jayanta.adhikari



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~