Adristo - A bengali story

Jolchobi

অদৃষ্ট

অর্ণব কর

অফিসের তাড়া থাকায় শ্যামল না খেয়েই বেরিয়ে গেল। বউ শ্যামা অনেক বার পিছন থেকে ডাকলেও শ্যামল সে দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে অফিসের ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে রীতিমত দৌড়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌছাল। বাস স্ট্যান্ডে এসে শ্যামল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, পাশের লোকটাকে জিজ্ঞেস করে "9.15র বাসটা কি বেরিয়ে গেছে?" নেতিবাচক সম্মতি জানায় লোকটা। সে জানে আজ যদি সে এই বাসটা না ধরতে পারে,তবে হয়তো তার জীবনটাই অন্যরকম হয়ে যাবে। বাসটা যায়নি শুনে শ্যামলের কিছুটা আক্ষেপ হয় না খেয়ে আসার জন্য।এমনিতেই কাজের তুলনায় এই অফিসে মাইনেটা একটু কমই দেয়, যদিও যা ওভারটাইম দেয় তাতে চায়ের জলও গরম হয় না।সে অনেকবার ভেবেছে এই চাকরিটা ছেড়ে অন্য চাকরি খুঁজে নেবে, কিন্তু প্রতি বারই কিছু না কিছু বাধা এসেই পরে। এবারেও বসের সাথে তুমুল ঝগড়া হওয়ার পর সে ভেবেছিল চাকরিটা সেদিনই ছেড়ে দেবে, কিন্তু ওই,সেদিনও ছাড়া যায়নি। হয়তো ভগবানেরই তেমনি বিধান। না হলে এই আট বছরে কম লোকতো ছেড়ে যায়নি চোখের সামনে, তবুও তার ছাড়া হয়ে ওঠেনি। সে যে ছেড়ে দেবে যে কোনোদিন সেটা অফিসের পিওন থেকে মালিক সবাই জানে। পিছনে এটা নিয়ে হাসাহাসিও করে।তাও কেন যে চাকরিটা ছাড়া যায়না সেটা সে নিজেও ভেবে পায়না। সেই তো শেষ বার অন্য জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়ে বেশি মাইনেতে কাজ করার জন্য রাজি হয়ে সাথে করে অফার লেটারটা অবধি নিয়ে এসেছিল,কিন্তু ওই সেদিনই রাত্রে বড় বাবু নিজে ফোন করে বললেন দু দিনের জন্য রাঁচি যেতে হবে। সে সামান্য কিছু ট্রাভেল এক্সপেন্স পাবে বলে রাজি হয়ে সেখানে চলে গিয়েছিল। কিন্তু পাক্কা তিন মাস পর সে বাড়ি ফিরেছিল। তারপর সেই নতুন কোম্পানিতে যেতে তাকে পিছনের বেরোনোর দরজা দেখানো হয়,কারণ তার জন্য অপেক্ষা করে করে তার জায়গায় দশ দিন আগেই নতুন ছোকরা নিয়োগ করা হয়েছিল। শ্যামলের কপালটা ঠিক এই রকমই। তবুও সে চাকরি পরিবর্তনের চেষ্টা তলায় তলায় চালিয়ে যাচ্ছে। কাল রাত্রেই বন্ধু মিহির একটা চাকরির খবর দেয়। তাই সে সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে, যাতে অফিসে তাড়াতাড়ি পৌঁছে, জরুরি কাজগুলো শেষ করেই তাড়াতাড়ি বেরোতে পারে।দেখতে দেখতে প্রায় আট মিনিট পর বাসটা স্টপেজে এসে দাঁড়ায়।আজ যেন অন্য দিনের থেকেও ভিড়টা খুব বেশি। খুব কষ্ট করে ঠেলেঠুলে কয়েকজন নামতেই স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন দৌড়ে উঠে ফাঁকা জায়গাটা ভরাট করে নিল। এখন এমনই অবস্থা দাঁড়ালো শ্যামলকে যদি সময়ে অফিসে যেতে হয় তবে কোনোরকমে একটা পা সেই পাদানিতে তুলে হাত দিয়ে পাশের রড ধরে দেহের পুরোটাই বাইরে ঝুলিয়ে হওয়া খেতে খেতে অফিসে যেতে হবে। বাসটা ছেড়ে দেবার জন্য কন্ডাক্টরের আওয়াজ পেতেই সেটা গড়াতে শুরু করলো। আর কোনো ভাবার সুযোগ না থাকায় সে সেই চলন্ত বাসের পাদানিতে কোনোরকমে পা তুলে দিয়ে ডানহাত দিয়ে শক্ত করে রড টাকে ধরল। বাসটা আজ যেন খুব তাড়াতাড়ি চলছে মনে হলো।অতিরিক্ত গতিতে সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে পরের গন্তব্যে এগিয়ে চললো।হঠাৎই শ্যামলের চোখে পড়লো সেই ছেলেটাকে,তিনদিন আগে যাকে সরিয়ে শ্যামল তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমেছিল,আর সেই তাড়াহুড়তেই তার চোখের সামনে ঘটে গিয়েছিল ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। আসলে সেদিন বাসের গেটের মুখে ভিতরে ঢুকতে না পেরে অনেক লোকের জটলা হয়েছিল। তাড়াতাড়ি নামার সময় অফিসের ব্যাগটা কাঁধ থেকে হাতে নিয়ে নিয়েছিল।স্টপেজ আসার সাথে সাথেই সেই ভিড়টা ঠেলে কোনোরকমে ধস্তাধস্তি করে শ্যামল বাস থেকে নেমে যায়।কিন্তু তার ব্যাগটা কারোর একটা কনুইয়ে ফাঁকে আটকে যায়। সে নিচে নামতেই বাসটা চলতে শুরু করে দেয়।সেইজন্য ব্যাগটা তাড়াতাড়ি বার করার জন্য একটা জোরে হ্যাঁচকা টান দেয়। বাসটা ততক্ষনে তার নিজস্ব গতি নিয়ে নিয়েছে,শ্যামলও তার সাথেই পাল্লা দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে।আর ব্যাগটাতে যেইনা জোরে টান দিয়েছে,যে ছেলেটির কনুইয়ের ফাঁকে সেটা আটকে ছিল,সেই ছেলেটির হাত থেকে বাসের রডটা ফস্কে সোজা সে বাসের নিচে চলে যায়। কন্ডাক্টর আর সহযাত্রীদের চিৎকারে ড্রাইভার যতক্ষণে ব্রেক কষে, ততক্ষনে ছেলেটির মাথা পিছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে গুড়িয়ে গেছে।শ্যামল ততক্ষনে তার ব্যাগটা হাতে পেয়ে গেছে, সেই খুশীতে সে অফিসের দিকে হাঁটা লাগায়। কিন্তু তার জন্য যে একটা প্রাণ অকালে ঝরে গেল সে তার কোনো খবরই রাখলো না। সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে যখন সে বাড়ি ফিরে টিভিতে খবর চালিয়ে ডিনার টেবিলে খেতে বসে,তখন সেই দুর্ঘটনার খবরটি সম্প্রচারিত হয়। ঘোষক যখন বার বার করে দুর্ঘটনাটা কিভাবে হলো ব্যাখ্যা দিতে থাকে,তখন শ্যামলের চোখের সামনে সকালের ঘটনাটা ভেসে ওঠে।তারপর থেকে টানা তিন রাত সে ভাল করে ঘুমাতে পারেনি।চোখ বুজলেই ছেলেটার করুন মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে,আর বার বার মনে পড়ে যায় বাসের চাকার তলায় পিষ্ট হওয়া দেহটা।

আজ এই ইন্টারভিউটা থাকায় সকাল সকাল অফিসের উদ্দেশ্যে তাকে বেরোতে হয়েছে। সে ভিড় বাসে ঝুলতে ঝুলতে দেখতে পেল সেই ছেলেটাকে,যে সারা গায়ে রক্ত স্নান করে পরের বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছানোর ঠিক আগেই দাঁড়িয়ে আছে।থেতলানো মাথা থেকে চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে রক্তমাখা চোয়ালের উপর ঝুলে আছে। শ্যামল তার নিজের চোখের সামনে এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে সভয়ে দুচোখ বন্ধ করে নিল। বাসের হাতলটাকে আরো শক্ত করে চেপে ধরে নিজের পা কে, পাদানির আরো একটু ভিতরে ঢোকানোর চেষ্টা করল। হঠাৎই তার ঝুলন্ত শরীরে একটা তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করলো। কে যেন তার ঝুলন্ত দেহটা ধরে বাইরে থেকে হ্যাঁচকা টান মারলো। সেই সঙ্গে কন্ডাক্টর আর সহযাত্রী সবাই সমস্বরে চিৎকারকরে বাসটাকে থামাতে বলতেই আজও ড্রাইভার খুব জোরে ব্রেকে চাপ দিল।কিন্তু শ্যামলের ঝুলন্ত দেহটা পিছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে ধড় থেকে মুন্ডুটা আলাদা হয়ে রাস্তার দুদিকে ছিটকে গেল।

এবারেও শ্যামলের আর চাকরিটা বদলানো হল না।

সমাপ্ত

© FB.com/arnab.kar.39



Facebook Twitter Google Digg Reddit LinkedIn Pinterest StumbleUpon Email



~~ জলছবি ~~